গত কয়েক মাসে দেশে রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতির পেছনে ‘এলসির আড়ালে টাকা পাচার’ একটি কারণ হতে পারে বলে সন্দেহ করছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
আগামী প্রজন্মের কথা চিন্তা করে এ ধরনের অন্যায় কাজ থেকে ‘বিরত থাকার আহ্বানও’ তিনি জানিয়েছেন।
বুধবার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত ও অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে কথা বলেন মন্ত্রী।
দেশের আমদানি-রপ্তানি খাতে বিভিন্ন দুর্নীতির প্রসঙ্গ উঠলে তিনি বলেন, “কতটা দুর্নীতি হয় আমার কাছে তথ্য নেই। কিন্তু আমরা অনুমান করে বলতে পারি যে দুর্নীতি হচ্ছে।
“তা না হলে আমদানির চাইতে রপ্তানি বেশি হবে না কেন? আমদানির চাইতে রপ্তানি যদি বেশি না হয়, তাহলে আমরা রপ্তানিটা কেন করব? এই প্রশ্নটা কিন্তু খুব সহজেই এসে যায়।”
মুস্তফা কামাল বলেন, “আমরা কাঁচামাল এনে, এগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করি। কাঁচামালের সঙ্গে প্রক্রিয়ার খরচ যোগ করে সেটা যদি রপ্তানি করা হয়, সেটা তো আমদানির চেয়ে কম হতে পারে না। বিশেষ কারণে একবার দুবার কম হতে পারে। এটাই স্বাভাবিক প্রশ্ন। সেজন্য আমরা সব সময় আশা করি যে আমদানির চেয়ে রপ্তানি বেশি হবে।”
আমদানির চাপ বেড়ে যাওয়ায় গত ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে দেশের পণ্য বাণিজ্যের ঘাটতির পরিমাণ ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে; যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮২ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার। আর এ সময়ে রপ্তানি আয় এসেছে ৪৯ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার।
আমদানির পরিমাণ যেভাবে বাড়ছে, তাতে বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে কি না, সে সন্দেহের কথা অর্থনীতিবিদরা আগেই বলেছিলেন।
আমদানি-রপ্তানিকারকেরা পণ্য আমদানি-রপ্তানির সময় প্রকৃত মূল্য না দেখিয়ে কমবেশি দেখানোর মাধ্যমে অর্থপাচার করেন। অর্থাৎ যে দামের পণ্য তিনি কিনছেন, তার চেয়ে বেশি দেখিয়ে (ওভার ইনভয়েসিং) বিদেশে পাচার করেন। একইভাবে রপ্তানি পণ্যের দাম কম (আন্ডার ইনভয়েসিং) দেখিয়েও ফাঁকি দেওয়া হয়।
ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) হিসাবে, বাংলাদেশ থেকে ছয় বছরে বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে মোট ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার ‘পাচার’ হয়েছে। তবে সরকারের কাছে এ বিষয়ে কোনো হিসাব নেই।
অর্থমন্ত্রী বলেন, “কিছুদিন আগে আমরা দেখলাম, আমদানি রপ্তানির ঘাটতিটা বেড়ে গেল। এজন্য বলছি যে আমাদের একটা ধারণা যে, সঠিকভাবে আমদানি রপ্তানি মূল্যায়িত হচ্ছে না। যা হচ্ছে সেটা এদিক সেদিক হচ্ছে।
“এজন্য আমরা দায়িত্ব নিয়ে কাজটি করছি। বিভিন্ন রেগুলেটরদেরকে নির্দেশ দিয়েছি, তারাও এগিয়ে এসেছে, যাতে সততা ও দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে আমদানি রপ্তানি করেন। যারা যা রপ্তানি করার কথা সেটা করবে, জেনুইনলি যেটা আমদানি করার কথা সেটা করবে “
পণ্যের পরিমাণ এবং মূল্য যদি ঠিক থাকে, তাহলে এভাবে বাণিজ্য ঘাটতি হবে না বলে মনে করেন মুস্তফা কামাল।
“আমদানি, পণ্য মূল্য ও পরিমাণ যদি অতিরঞ্জিত করা হয়, তাহলে সেটার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে টাকা দেশের বাইরে পাচার করা। এগুলো বন্ধ করতে হবে। আমাদের সঙ্গে সরকারের সঙ্গে সবাইকে সংযুক্ত হতে হবে।“
কী পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে তার কোনো হিসাব সরকারের কাছে না থাকলেও চলতি অর্থবছরের বাজেটে পাচার করা অর্থ নির্ধারিত হারে কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে দেশে আনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
এর ফলে সাড়ে ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিদেশ থেকে আনা অর্থ দেশে সরকারের খাতায় বৈধ আয়ের তালিকায় যুক্ত করা যাবে। ওই আয়ের উৎসও জানতে চাওয়া হবে না। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও অর্থমন্ত্রীর যুক্তি ছিল, যেটা পাচার হয়ে গেছে সেটা এদেশের মানুষের ‘হক’। সেই হক ফিরিয়ে আনতেই এ ব্যবস্থা। বাধা দিলে কোনো টাকা ফিরবে না।
দেশে রেমিটেন্সে প্রণোদনা দেওয়া হলেও এখনও হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স আসছে এবং টাকা পয়সা লেনদেন হচ্ছে বলে বুধবার স্বীকার করেন অর্থমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “এখনও হুন্ডি তো আছেই। এখনও হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পয়সা আসে বলেই আমাদের কাছে তথ্য আছে। আমরা এগুলো নিরুৎসাহিত করছি। কী পরিমাণ হুন্ডিতে আসছে এ বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। তবে আগে একটা স্টাডি করেছিলাম, যাতে দেখা গেছে অফিসিয়াল চ্যানেলের প্রায় কাছাকাছি।
“অফিসিয়াল চ্যানেলে সেই সময় আসত ৫১ শতাংশ, হুন্ডিতে আসতো ৪৯ শতাংশ। সেজন্য আমি মনে করি সেই ধারাবাহিকতা এখনও আছে।”
মন্ত্রী বলেন, “হুন্ডির মাধ্যমে টাকা আনলে সেটা কালো টাকা, এর কোনো ব্যাখ্যা থাকে না। এটাকে অর্থনীতির আওতায় হিসাব করা যায় না। যারা টাকাগুলো নিয়ে আসেন, তারাও বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন। এই টাকা কোথাও রেকর্ডও করা যাচ্ছে না। ইনকাম ট্যাক্স কর্তৃপক্ষ যদি প্রশ্ন করে তারা এর উত্তর দিতে পারবেন না।”