নিজস্ব প্রতিবেদক : অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি নিয়েই চলছে রাজশাহীর পাঁচটি মার্কেট। ফায়ার সার্ভিস বার বার সতর্ক করলেও মার্কেটগুলো ভাঙা হচ্ছে না। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে মার্কেটগুলোর সামনে সতর্কতামূলক ব্যানার টানানো হলেও রাতারাতি তা খুলে ফেলা হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতার কারণে ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটগুলো এখনও ভাঙা হচ্ছে না বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
মার্কেট পাঁচটি হলো- নগরীর সাহেববাজারের আরডিএ মার্কেট, রাজশাহী নিউমার্কেট, হড়গ্রাম নিউমার্কেট, সোনাদীঘি এলাকার সমবায় মার্কেট এবং নগরীর সাহেববাজার কাপড়পট্টি। এরমধ্যে আরডিএ মার্কেট হলো রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) মালিকানাধীন। সমবায় মার্কেটটি সমবায় বিভাগের। রাজশাহী নিউমার্কেট ও হড়গ্রাম নিউমার্কেট রাজশাহী সিটি করপোরেশনের। আর কাপড়পট্টি গড়ে উঠেছে সাধারণ ব্যবসায়ীদের দোকানপাট নিয়ে।
এ পাঁচ মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে তা নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হবে বলে জানিয়েছে রাজশাহী ফায়ার সার্ভিস। আশপাশে পানির উৎস না থাকার কারণে মার্কেটগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মার্কেটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে আরডিএ মার্কেট। ঘিঞ্জি এই মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকার উপায়ও নেই।
সাহেববাজার এলাকার সড়কটি সম্প্রসারণের সময় ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করে ১৯৯০ সালে আরডিএ মার্কেটে পুনর্বাসিত করে। তিনতলা এই মার্কেটে ১ হাজার ৯৫২টি দোকান রয়েছে। এই মার্কেটের তিনপাশেই সরু রাস্তা। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকার কোন উপায় নেই। সামনে প্রশস্ত রাস্তা থাকলেও প্রধান ফটকের কারণে মার্কেটের ভেতরে গাড়ি ঢুকতে পারবে না। মার্কেটটিতে মুদি দোকান, খাবারের হোটেল, কাপড়, কসমেটিক্স থেকে ক্রোকারিজ ও ইলেক্ট্রনিক্সের দোকানও রয়েছে। ফলে মার্কেটটিতে অগ্নিকাণ্ডের চরম ঝুঁকি রয়েছে।
গত ৮ জানুয়ারি রাতে মার্কেটের প্রধান ফটক সংলগ্ন বাইরের অংশে একটি মুদি দোকানের দোতলার গুদামে আগুন লাগে। পরে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট প্রধান সড়ক থেকে প্রায় দুই ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এই আগুন খাঁচার মতো ঘিঞ্জি মূল মার্কেটে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং বহু মানুষের হতাহতের আশঙ্কা ছিল।
অগ্নিকাণ্ডের চরম ঝুঁকি থাকায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি কয়েকব বছর আগেই আরডিএ মার্কেট ভেঙে ফেলতে সুপারিশ করে। তবে মার্কেটটি এখনও ভাঙা হয়নি। এই মার্কেটে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ কেনাকাটা করেন। ঈদের সময় মার্কেটের ভেতরে পা ফেলার জায়গা থাকে না। তাই ফায়ার সার্ভিস প্রতিবছরই ঈদের সময় ক্রেতাদের সতর্ক করে মার্কেটের সামনে ব্যানার টানিয়ে দেয়। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা চলে গেলেই ওই ব্যানার গায়েব হয়ে যায়।
সবশেষ গত ১৭ এপ্রিল আরডিএ মার্কেট, রাজশাহী নিউমার্কেট, হড়গ্রাম নিউমার্কেট, সমবায় মার্কেট ও সাহেববাজার কাপড়পট্টিকে অগ্নিনিরাপত্তায় ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ব্যানার টানিয়ে দেয় ফায়ার সার্ভিস। ব্যানারে লেখা ছিল, ‘অগ্নিনিরাপত্তার দিক থেকে এই মার্কেট খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক হওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হলো।’ সেদিন সবাইকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়ে মাইকিং করার পাশাপাশি প্রচারপত্রও বিতরণ করা হয়।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের রাজশাহী বিভাগের উপ-পরিচালক ওহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এসব মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণের তেমন ব্যবস্থা নেই। আমরা এ বিষয়ে বারবার চিঠি দিলেও মার্কেট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আরডিএ মার্কেটের আশপাশে পুকুর নেই। ফলে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে পানির অভাবে আগুন নেভাতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। এই মার্কেটগুলোর সিঁড়িতেও মালামাল রাখা হয়। ফলে আগুনের ঘটনা ঘটলে মানুষ সহজে নামতে পারবেন না। আরডিএ মাকের্টের ভেতরে এলোমেলোভাবে বৈদ্যুতিক তার রয়েছে। ফলে সহজেই দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এসব কারণে মার্কেটগুলো ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে।’
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আরডিএ একাধিকবার তাদের মার্কেট ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকির বিষয়টি আরডিএ মার্কেটের ব্যবসায়ীরা মানতেই চান না। একইভাবে নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীরাও ঝুঁকির কথা মানতে চান না। আরডিএ মার্কেটের এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, মার্কেট ভাঙা হলে তাদের কবে কোথায় পুনর্বাসিত করা হবে তার কোন ঠিক নেই। নতুন মার্কেট না হওয়া পর্যন্ত তাদের ব্যবসাও বন্ধ থাকার আশঙ্কা রয়েছে। সেই কারণেই মূলত তারা মার্কেট ভাঙার বিরোধিতা করে থাকেন।
মার্কেটের ঝুঁকির বিষয়ে জানতে চাইলে আরডিএ’র চেয়ারম্যান জিয়াউল হক বলেন, ‘মার্কেটের অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সম্প্রতি আমরা প্রায় ২০০টি ফায়ার এক্সট্রিংগুইসার দিয়েছি। পাশ দিয়ে বিদ্যুতের লাইন আছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সব সতর্কতা অবলম্বনের জন্য আমরা বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থার সঙ্গেও কথা বলেছি। আমাদের সতর্কতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ চলমান। মার্কেটটা ভাঙার পরিকল্পনা আছে। সেটা নিয়েও কাজ চলছে।’
দুই নিউমার্কেটের ঝুঁকির বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর ইসলাম তুষার বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস কোন কোন মাপকাঠিতে কীভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে তা বলতে পারব না। তবে অনেকেই একরকমভাবে দোকান বরাদ্দ নিয়ে অন্য ব্যবসা শুরু করেন। অবকাঠামোর আকৃতিও পরিবর্তন করে দেন। এক্ষেত্রে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। হড়গ্রাম নিউমার্কেটে এ ধরনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। সেটা দেখে বলতে পারব। তবে আমার কাছে রাজশাহী নিউমার্কেটকে খুব বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয় না। এর তিন দিকে বড় রাস্তা আছে। ভবনও মাত্র দোতলার। তারপরও সেটাকে ভেঙে অত্যাধুনিক মার্কেট করার পরিকল্পনা আছে।