নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহী মহানগরীর চন্দ্রিমা থানার দায়রা পাকের মোড় মেহেরচন্ডি এলাকায় রাস্তার পাশেই অবৈধভাবে একটি পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। প্রায় সাড়ে ৪ বিঘা আয়তনের পুকুরটি ভরাট করতে গত সোমবার (২৫ মার্চ) রাত থেকেই কাজ শুরু করেন শ্রমিকরা। আইন অনুযায়ী রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকায় পুকুর-জলাশয় ভরাট নিষিদ্ধ হলেও আইনের তোয়াক্কা না করে অবৈধ এ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। অজ্ঞাত কারণে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও নীরব ভূমিকা পালন করছে।
এদিকে, পুকুর ভরাটের দায়িত্বে থাকা নগরীর মতিহার থানার মোহনপুর এলাকার ছানা ও লালন বলেন, ২০২০ সালে ৮ কোটি ১০ লাখ টাকা মূল্যে সাড়ে ৮ বিঘা আয়তনের পুকুরটি ক্রয় করেছেন সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ১১ জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। তবে মালিকানায় কারা রয়েছেন এ ব্যাপারে মুখ খুলছেন না তারা।
পুকুরটি ভরাট করতে একজন জেলা প্রশাসক প্রভাব খাটাচ্ছেন বলে জানালেও তিনি কোন জেলার ডিসি তা বলছেন না ভরাটের দায়িত্বে থাকা ছানা ও লালন।
আইন অমান্য করে কেন পুকুর ভরাট করা হচ্ছে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ছানা বলেন, পুকুরের শ্রেণি পরিবর্তন করা হয়েছে। এছাড়া এখানে অনেকগুলো মালিক রয়েছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর আর কোনো কথা না বলেই তিনি দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। পরে খবর পেয়ে ওই দিন রাতেই চন্দ্রিমা থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পুকুর ভরাটের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পুকুর ভরাটের দায়িত্বে থাকা ছানা ও লালন গত সোমবার রাত থেকেই সেটি ভরাটের লক্ষ্যে শ্রমিকদের দিয়ে কাজ শুরু করেন। এক দিকে শ্যালো মেশিন দিয়ে পুকুরের পানি নিষ্কাশনের কাজ চলছে, আরেক দিকে ড্রাম ট্রাকে করে বালু নিয়ে এসে পুকুর পারে রাস্তার ওপর ফেলা হচ্ছে। অন্য দিকে হুইল লোডার মেশিন দিয়ে রাস্তার ওপর পড়ে থাকা বালুগুলো নামিয়ে দেয়া হচ্ছে সেই পুকুরে। রাতে পুকুরটির কিছু অংশ ভরাট হয়ে যায়। পরে পুলিশ গিয়ে কাজ বন্ধ করে দেয়।
পুকুরটি মাছ চাষের জন্য পূর্বের মালিক গোলাম মওলা ও তার শরিকদের কাছ থেকে লিজ নিয়েছেন মেহেরচন্ডী এলাকার সোহেল রানা। তিনি জানান, গত ৬ বছর থেকে পুকুরটিতে তিনি মাছ চাষ করে আসছেন। কিন্তু তাকে না জানিয়ে গোপনে পুকুরটি বিক্রি করেছেন মালিকরা।
প্রতি বছর ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা আমার খরচ হয়। রাতের আধারে এভাবে পুকুর ভরাট হলে আমি ব্যাপক ক্ষতির মধ্যে পড়বো।
তিনি আরও বলেন, এর আগে আব্দুল হালিম নামের এক ব্যক্তি পুকুর পারে একটি ব্যানার দিয়ে ছিলেন। তবে কে বা কারা ব্যানারটি ফেলে দেয়। কাগজ কলমে পুকুরের আয়তন সাড়ে ৪ বিঘা হলেও বাস্তবে তা হয়ে আছে সাড়ে ৮ বিঘা। আর পুকুরটির জন্য গোলাম মওলা ছাড়াও অন্য মালিকদের বাৎসরিক খাজনা দিতে হয় বলে জানান তিনি।
রাজশাহী জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. কবির হোসেন বলেন, এর আগে মেহেরচন্ডি এলাকায় ওই পুকুর ভরাটের অভিযোগে ঘটনাস্থলে গিয়ে কাজ বন্ধ করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী পৌর অথবা সিটি করপোরেশন এলাকার ভেতরে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া জলাধারের আকার পরিবর্তন করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু তার পরও রাজশাহীতে অব্যাহতভাবে চলছে পুকুর-জলাধার ভরাট। এতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। যে কয়টি জলাশয় রয়েছে সেগুলো সংরক্ষণ করা না গেলে ভবিষ্যতে কোনো স্থানে আগুন নেভানোর পানি পাওয়াও দুষ্কর হয়ে পড়বে বলে মনে করেন তিনি।
রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) সূত্র জানায়, নগরীতে ১২০টি পুকুরের মধ্যে কর্তৃপক্ষ মাত্র ২২টি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। সম্প্রতি দুই একরের বেশি আয়তনের ২২টি পুকুর সরকারিভাবে সংরক্ষণের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। তবে ব্যক্তি মালিকানাধীন অন্য পুকুরগুলোর বিষয়ে রাসিকের কোনো বক্তব্য নেই।
নদী ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হোসেন আলী পিয়ারা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, এর আগে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) একটি প্রচারপত্র বিলি করেছিল। ওই প্রচারপত্রে বলা হয়, নগরীতে কেউ পুকুর ভরাট করতে চাইলে অনুমতি নিতে হবে। এমনকি কেউ অবৈধভাবে পুকুর ভরাটের বিষয়ে টেলিফোনে অভিযোগ করলেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র এর বিপরীত। আরডিএ কর্তৃপক্ষকে সরাসরি জানালেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগরীর সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন, সিটি করপোরেশনের আওতাধীন যে সব এলাকায় পুকুর-জলাশয় ভরাট হচ্ছে তার সবগুলোই ওই এলাকার কাউন্সিলর, সরকার দলীয় স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা ও সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ ম্যানেজ করে করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে রাসিকের এক ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, এ ব্যাপারে আরডিএ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করুন। তারা পদক্ষেপ নেবে। এ ছাড়া রাসিক কর্তৃপক্ষও ব্যবস্থা নেবে বলে জানান তিনি।
এ ব্যাপারে জানার জন্য যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও আরডিএর সহকারী নগর পরিকল্পক মো. সাদরুল আনাম ফোন না ধরায় তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
চন্দ্রিমা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাহবুব আলম বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থল গিয়ে পুকুর ভরাটের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিষয়গুলি দেখেন এসিল্যান্ড ও ইউএনও মহোদয়। তাদের কোনো লিখিত নির্দেশনা পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
রাজশাহী জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ জানান, পুকুর ভরাটের সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক, তারা কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এ বিষয়ে তিনি একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস প্রদান করেন।