নাহিদ ইসলাম,নিজস্ব প্রতিবেদক: পদ্মায় পানির উচ্চতা কমতে থাকলেও রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে পদ্মার পানিকে প্রধান উৎস ধরে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করছে ওয়াসা। ওয়াসা বলছে, সারা বছর এখানে অন্তত ৩০ ফুট গভীর পানি থাকবে। প্রতিদিন পানি সাপ্লাই দেবে ২০ কোটি লিটার।
তবে ওয়াসার প্রকল্প নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, যেখানে পদ্মায় পানিই থাকে না, সেখানে এতো বড় প্রকল্প শেষমেষ আত্মঘাতী না হয়ে দাঁড়ায়।
রাজশাহীর কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া পদ্মা নদীর পানির উচ্চতা এক দশকে নেমেছে প্রায় ১০ মিলিমিটার। সেইসঙ্গে আশঙ্কাজনক হারে নামছে রাজশাহী অংশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। শুষ্ক মৌসুমে রাজশাহী নগরীতে প্রতিদিন পানির চাহিদা থাকে ১৩ কোটি লিটার। চাহিদার বিপরীতে ওয়াসা সাপ্লাই দিচ্ছে ১০ কোটি ৭০ লাখ লিটার। অর্থাৎ প্রতিদিন ঘাটতি থাকে ২ কোটি ৩০ লাখ লিটার পানি।
ওয়াসা বলছে, রাজশাহীর গোদাগাড়ী পয়েন্টে চীন-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ৪ হাজার ৬২ কোটি ২২ লাখ টাকার ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এ শঙ্কট থাকবে না। যদিও রাজশাহীতে সুপেয় পানির জন্য ২০১১ সালে শ্যামপুরে ১০৩ কোটি টাকার পানি শোধনাগারটি পদ্মায় পানি না থাকায় বছরের অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকে। প্রায় ৩০ ভাগ নাগরিক এখনো ওয়াসার সেবা থেকে বঞ্চিত।
রাজশাহী ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, এই প্রকল্পে মোট ব্যয় হবে ৪ হাজার ৬২ কোটি টাকা। চীনের হুনান কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড কাজটি বাস্তবায়ন করছে। পদ্মায় সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনে চীনা এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ২০২১ সালের ২১ মার্চ চুক্তি করে রাজশাহী ওয়াসা। এই ট্রিটমেন্ট প্লান্টের মাধ্যমেই ২০৩৫ সালের মধ্যে রাজশাহী অঞ্চলে পানি সরবরাহ শতভাগ নিশ্চিত করা হবে বলে আশা ওয়াসা কর্তৃপক্ষের।
প্রকল্প ব্যয়ের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দেবে ১ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা। আড়াই থেকে তিন শতাংশ সুদে হুনান কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ার গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড ২ হাজার ৩১৩ কোটিরও বেশি টাকা ব্যয় করবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময়সীমা চার বছর।
রাজশাহী ওয়াসা জানায়, শহরে এখন প্রতিদিন পানির চাহিদা ১১ কোটি ৩২ লাখ লিটার। চাহিদা মেটাতে প্রতিদিন পাম্পের সাহায্যে ভূগর্ভস্থ ৮ কোটি ৬৫ লাখ লিটার পানি তোলা হয়। আর এখন মাত্র ৯০ লাখ লিটার ভূ-উপরিস্থ পানি পরিশোধন করা হয়। তাও প্রতিদিন ১ কোটি ৭৭ লাখ লিটার পানির ঘাটতি থেকে যায়। নতুন প্লান্ট হলে ঘাটতি থাকবে না।
এজন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০১৫ সালে এ প্রকল্পের খসড়া সম্পন্ন করা হয়। এরপর ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুমোদন হয়। পরে একই বছরের অক্টোবরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় প্রকল্পটি পাস হয়। এরপর নানা সমীক্ষা চলছিল। সবকিছু চূড়ান্ত হওয়ার পরই চীনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। এখন কাজ শুরু হতে যাচ্ছে।
সরেজমিনে গোদাগাড়ী উপজেলা সদরের সারেংপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পদ্মা নদীর যে স্থানে ট্রিটমেন্ট প্লান্টটি স্থাপন করা হচ্ছে সেখানেই ভারত থেকে গঙ্গা নদী বাংলাদেশে ঢুকে পদ্মা হয়েছে। এখান থেকেই আবার পদ্মার শাখা নদী হিসেবে বেরিয়ে গেছে মহানন্দা। দুই নদীর মোহনায় ওয়াসার এই ট্রিটমেন্ট প্লান্ট করা হচ্ছে। এরইমধ্যে জমি অধিগ্রহণ শেষ করে কাজ শুরু হয়েছে। চলছে বালু ভরাটের কাজ। পাশাপাশি স্থাপন করা হয়েছে বেজ ঢালাই ও পাইলিংয়ের জন্য মিক্সিং মেশিন। আগামী মাসে এই প্রকল্পের মূল কাজ শুরু হবে।
এদিকে রাজশাহীর হরিপুর এলাকায় নির্মাণকাজ চলছে বুস্টার পাম্প প্রকল্পের। এই পাম্পের কাজও এগিয়ে চলেছে। এখানে মাটি খণন করা হয়েছে। সেইসঙ্গে বিভিন্ন বুস্টারপাম্প নির্মাণের জন্য বিদ্যুৎ সাবস্টেশন নির্মাণের কাজ শেষের পথে।
রাজশাহী ওয়াসা প্রকল্পের চীনা প্রধান প্রকৌশলী সানচিং বলেন, আমরা কাজ শুরু করেছি। এরইমধ্যে ভরাটের কাজ শেষ করেছি। আগামীতে এখানে পাইলিং ও অন্যান্য কাজ শুরু করা হবে।
রাজশাহী ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট প্রকল্পের উপ-সহকারী প্রকৌশলী এনামুল হক বলেন, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০১৫ সালে এ প্রকল্পের খসড়া সম্পন্ন করা হয়। প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। বাস্তবায়নে অপেক্ষা করতে হবে ২০২৬ সাল নাগাদ।
তিনি বলেন, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এখন সার্ভের কাজ শেষ হয়েছে। অন্যান্য কাজগুলো শুরু হচ্ছে। ২০২৬ সাল নাগাদ এই প্রকল্প থেকে প্রতিদিন পানি সাপ্লাই দেবে ২০ কোটি লিটার।
রাজশাহী ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাকীর হোসেন বলেন, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মধ্যে আমাদের যে গ্রাহক রয়েছে সবারই একটি কাঙ্ক্ষিত প্রকল্প এটি। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ভূগর্ভস্থ পানি যে নেমে যাচ্ছে, এছাড়া সাধারণ পানিতে যে আইরন থাকে সেটা থেকে নিরপদ পানি উৎপাদন হবে। যেটি আমাদের এসডিজি লক্ষ্যমাত্রায় আছে সেটি আমরা পূরণ করতে সক্ষম হবো। এটি প্রায় ২০৪০ সাল পর্যন্ত যে ডিমান্ড হবে সেটিও ফুলফিল করতে সক্ষম হবে।
তবে এর আগেও ওয়াসার শত কোটি টাকার প্রকল্প খুব একটা কাজে না আসায় ওয়াসার ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, অধিকাংশ সময় পদ্মায় পানি থাকে না। তার উপর এতো বড় প্রকল্প শেষে না আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়ায়।
রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, ওয়াসা যে প্লান্টটি করছে, এটির যে ফিজিবিলিটি স্টাডি করেছে আমি মনে করি এটি ত্রুটিপূর্ণ। কারণ সেখানে পানি তুলছে জনস্বাস্থ্য, বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড। এখন যোগ হয়েছে ওয়াসা। সেখানে পানি অ্যাভেলেবল কি না আমার জানা নেই। আপনারা জানেন ফারাক্কা পানি চুক্তি আগামী ২০২৬ সালে শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং আমার মনে হয় ওয়াসার এই প্লান্ট প্রকল্প আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া অন্য কিছু না।
রাজশাহী সুজনের সমন্বয়ক মিজানুর রহমান বলেন, বিভিন্ন জায়গায় দাবদাহ চলছে। এর ভেতরে ওয়াসা পানির বিল বাড়িয়েছে। কিন্তু তাদের যে সেবা দেওয়ার কথা ছিল সেটা নাগরিক সমাজ পাচ্ছে না। নতুন করেও কোনো সুবিধা পায়নি।
তিনি আরও বলেন, তারা এরআগেও এসব শোধনাগার নির্মাণ করে শতভাগ পানি সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিলেও সেটি করতে পারেনি। এখনো রাজশাহী শহরে পানির ঘাটতি আছে। ফলে এই প্রকল্প আসলে কতটা পূরণ করতে পারবে সেটিই দেখার বিষয়।