নাহিদ ইসলাম,নিজস্ব প্রতিবেদক: জাল সনদে পুলিশে চাকরি নিয়ে বিভিন্ন জেলায় ১৭ বছর ৫ মাস ১৬দিন চাকরি করেন পুলিশের সহকারি উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মো. আল মামুন। কনস্টেবল থেকে পদোন্নতি পেয়ে এএসআই। তবে জাল সনদে চাকরি নেওয়ার বিষয়টি জানাজানি হলে অক্ষম রোগী সেজে পুলিশের চাকরি থেকে স্বেচ্ছাবসর গ্রহণ করেন। অবসরের সময় পুলিশ বিভাগ থেকে অবসরকালীন আর্থিক সব সুবিধা গ্রহণ করেন।
এদিকে, নিজেকে অক্ষম ঘোষণা করে চাকরি থেকে স্বেচ্ছাবসার নিলেও এখন তিনি রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী। সম্প্রতি এক অনুসন্ধানের ফেরতপত্রে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড মামুনের এসএসসির সনদ জাল বলে নিশ্চিত করেছেন।
এই সনদ দেখিয়েই তিনি ২০০৩ সালে পুলিশ কনষ্টেবল পদে চাকরি নিয়েছিলেন। এই পুলিশ কর্মকর্তা চাকরিকালে কামিয়েছেন বিপুল অর্থ। দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে তুলেছেন বিপুল সম্পদ। তাঁর বেপরোয়া চালচলনে অতিষ্ঠ এলাকার মানুষ। তবে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা হওয়ায় ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারেন না।
জানা গেছে, এই সাবেক পুলিশ কর্মকর্তার আল মামুন। তাঁর বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের শ্যামপুর ইউনিয়নের উমরপুর গ্রামে। বাবা মফিজ উদ্দিন শ্যামপুর ইউপির ৮নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি। আল মামুন এখন আওয়ামী লীগ করেন।
গত ২১ মে অনুষ্ঠিত শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাচনে আল মামুন ভাইস-চেয়ারম্যান পদে টিয়া পাখি প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে পরাজিত হন। মামুন মনোনয়নপত্র দাখিল করলে গত ৩০ এপ্রিল জনৈক মোহা. ওলিউল্লাহ রিটার্নিং অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগে দাবি করেন তার এসএসসির সনদ জাল। তবে রিটার্নিং অফিসার এই বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আল মামুন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা থেকে ২০০৩ সালের ১৩ জুলাই পুলিশ কনষ্টেবল পদে যোগ দেন। তাঁর পুলিশ নং-৮৩০৩০৪৯৫৪৫। চাকরিতে যোগদানকালে তিনি রাজশাহীর গোদাগাড়ীর মহিষালবাড়ী আল ইসলাহ ইসলামী একাডেমী থেকে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের অধীন ২০০১ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় মানবিক বিভাগে উত্তীর্ণের সনদ প্রদর্শন করেন। যাতে প্রাপ্ত গ্রেড পয়েন্ট ৩ দশমিক ২৫ উল্লেখ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, আল মামুনের ট্রান্সক্রিপ্টে পরীক্ষার রোল গোদাগাড়ী নং-৫১৭৮১৬ এবং পরীক্ষার নিবন্ধন নং-৬১৬৪২৮/১৯৯৯ সাল উল্লেখ করা হয়েছে। ট্রান্সক্রিপ্টির সিরিয়াল নং-০৬১৯৩৭৬। ২০০১ সালের ৫ এপ্রিল ইস্যুকৃত প্রধান শিক্ষকের দেওয়া প্রশংসাপত্রের ক্রমিক নং-১৯৬।
তবে ট্রান্সক্রিপ্টে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম আল ইসলাহ ইসলামী একাডেমী হাইস্কুল উল্লেখ করা হলেও প্রশংসাপত্রে আল ইসলাহ ইসলামী একাডেমী লেখা রয়েছে। প্রশংসাপত্রে আল মামুনের জন্ম তারিখ লেখা হয়েছে ১৯৮৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর।
এদিকে, আল মামুনের এসএসসির শিক্ষা সনদ জাল বলে অভিযোগ আসার পর গত ৬ মে এই প্রতিবেদক আল মামুনের মাধ্যমিক পাশের ট্রান্সক্রিপ্ট ও প্রশংসাপত্রের অনুলিপি জমা দিয়ে সত্যতা জানতে চান প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকের কাছে। আল ইসলাহ ইসলামী একাডেমীর প্রধান শিক্ষক তারেক আহমেদ অনিক রেকর্ডপত্র যাচাই করে নিশ্চিত করেন ২০০১ সালে তার প্রতিষ্ঠান থেকে মো. আল মামুন নামের কোন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি। আল মামুনের প্রদর্শিত প্রশংসাপত্রটিও তারা দেননি। প্রধান শিক্ষক বলেন, নিশ্চিতভাবেই প্রশংসাপত্রটি জাল বলে আমরা মনে করছি।
অন্যদিকে, পুলিশ কর্মকর্তা আল মামুনের ট্রান্সক্রিপ্টটির ছায়ালিপি সংযুক্ত করে গত ৬ মে একটি পত্রিকার পক্ষ থেকে তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ এর ৮ (১) ও ৯ (১) ধারা মতে, রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করে সঠিক তথ্য সরবরাহের অনুরোধ করা হয়। গত ১৯ মে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক আরিফুল ইসলাম ও তথ্য কর্মকর্তা এসএম গোলাম আজম ফেরতপত্রে নিশ্চিত করেন ২০০১ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় মো. আল মামুন নামের কোন শিক্ষার্থীর অংগ্রহণ ও উত্তীর্ণের কোন রেকর্ড নেই বোর্ডের সংরক্ষিত রেকর্ডপত্রে। পুলিশ কর্মকর্তা আল মামুন গত ১৮ এপ্রিল শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাচনে ভাইস-চেয়ারম্যান পদের মনোনয়নপত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা ডিগ্রী পাশ উল্লেখ করেন।
এদিকে, পুলিশ বিভাগের সার্ভিস রেকর্ড বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, খুলনা পুলিশ লাইনে কনস্টেবল হিসাবে চাকরি জীবন শুরু করেন আল মামুন। এরপর ২০১৬ সালের ৫ আগষ্ট ময়মনসিংহ জেলা পুলিশে বদলি হন। ২০১৭ সালে কনষ্টেবল থেকে এএসআই পদে পদোন্নতি লাভ করেন। তাকে তারাকান্দা থানায় সংযুক্ত করা হয়। ২০১৮ সালের ১৭ আগষ্ট তাকে কুমিল্লা জেলায় বদলি করা হয়। ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি কুমিল্লা জেলার গৌরিপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে বদলি করা হয়। পরে বদলি করা হয় কুমিল্লা জেলা ডিবিতে। অক্ষমতাজনিত কারণ দেখিয়ে ২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর মামুন স্বেচ্ছাবসার গ্রহণ করেন। জানা গেছে চাকরি জীবনে আল মামুন জাতিসংঘের সুদান মিশনে একবার দায়িত্ব পালন করেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের শ্যামপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি আসাদুজ্জামান ভোদন বলেন, মামুনকে কখনো তারা পুলিশের পোশাকে দেখেননি। গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে তাকে নিজ এলাকা শিবগঞ্জে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকতে দেখা গেছে।
শিবগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আল মামুন নিজেকে পুলিশের একজন প্রভাবশালী উর্ধ্বতন কর্মকর্তার বডিগার্ড কাম পিএস পরিচয় দিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাজে নিয়মিত হস্তক্ষেপ করেন, বিশেষ করে পুলিশের কাজে। মোটরসাইকেলের সামনে পুলিশের স্টিকার লাগিয়ে মামুনকে শিবগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় রাউন্ড দিয়ে বেড়াতে দেখেছেন এলাকার মানুষ।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আল মামুন পোষ্টিং হওয়া থানা ফাঁড়িতে কখনো স্বশরীরে চাকরি করেননি। বরং তার এলাকার ওই উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা যেখানে বদলি হয়েছেন মামুন তার সঙ্গেই থেকেছেন। সূত্র মতে, কোন থানায় কোন ওসি পোষ্টিং যাবেন কাকে কোথায় বদলি করা হবে- গত ১০ বছর ধরে এসবই করেছেন এবং চাকরিতে না থেকে এখনো সেই কাজ করছেন মামুন। ঢাকা রেঞ্জের পুলিশ কর্মকর্তারা থানা ফাঁড়িতে পোষ্টিং নিতে এখনো মামুনেরই স্মরনাপন্ন হন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্বাচনি হলনামায় মামুন টিনসেড বাড়ির কথা বললেও গ্রামের বাড়ি উমরপুরে তৈরি পাকা বাড়ির কথা গোপন করেছেন। রাজশাহী মহানগরীর বহরমপুর এলাকায় পাঁচ কাঠা জমির ওপর থাকা কয়েক কোটি টাকার বাড়ির তথ্যও চেপে গেছেন। মামুন এলাকায় কিনেছেন জমি ও বাগান।
সোনামসজিদ বন্দর এলাকায় জমি কিনে করেছেন কয়লা ও পাথরের ইয়ার্ড। তিনি আমদানি রপ্তানি লাইসেন্স করে ভারত থেকে পাথর আমদানি করেন। হলফনামায় তিনি বছরে ১২ লাখ টাকা আয় করেন বলে দাবি করেছেন। উত্তরা ব্যাংক থেকে ২৯ লাখ টাকা ঋণ থাকার কথা হলফনামায় উল্লেখ করেছেন। আয়ের উৎস দেখিয়েছেন ব্যবসা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মো. আল মামুন বলেন, তার এসএসসির সনদ জাল নয়। তিনি আল ইসলাহ ইসলামী একাডেমী থেকে এসএসসি পাশ করেছেন। পরে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী করেন।
পুলিশে চাকরি করতে অক্ষম ঘোষণা করে স্বেচ্ছাবসার ও অবসরকালীন সুবিধা গ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওই সময় আমি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। এ কারণে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছি।
হলফনামায় রাজশাহীর বাড়ির কথা গোপন করা প্রসঙ্গে মামুনের দাবি রাজশাহীতে তার বাড়ি নেই। তিনি সম্প্রতি উপজেলা নির্বাচন করেছেন। তাই প্রতিপক্ষরা তার বিরুদ্ধে এসব রটাচ্ছেন। তিনি অবৈধভাবে কোন ইনকাম করেননি।