আইকন ডেস্ক : ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই প্রথম নীরবতা ভাঙলেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারতে আশ্রয় নেওয়া শেখ হাসিনা অভিযোগ করেছেন, তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিদেশি শক্তিগুলোর হাত রয়েছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা গত শনিবার তাঁর দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে একটি বার্তা দিয়েছেন। এই বার্তায় তিনি এমন অভিযোগ করেন। বার্তাটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্ট দেখতে পেয়েছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকটের পেছনে ‘বিদেশি শক্তির হাত’ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়ার কয়েক দিনের মাথায় এমন কথা বললেন শেখ হাসিনা।
অনেক দিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের টানাপোড়েন চলছিল। চলতি বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তিনি এক ‘শ্বেতাঙ্গ’ ব্যক্তির কাছ থেকে একটি প্রস্তাব পেয়েছেন। তাঁকে বলা হয়, বিমানঘাঁটি করতে দিলে তিনি সহজে ক্ষমতায় থাকতে পারবেন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারত যান শেখ হাসিনা। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠন করা হয় অন্তর্র্বতীসরকার।
শেখ হাসিনা এ ধরনের বিদেশি শক্তির দ্বারা ‘ব্যবহৃত’ না হওয়ার জন্য নতুন অন্তর্র্বতীসরকারকে সতর্ক করেছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, লাশের মিছিল যাতে দেখতে না হয়, সে জন্য তিনি পদত্যাগ করেছেন। তারা শিক্ষার্থীদের লাশের ওপর দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিল। তিনি তা হতে দেননি। শেখ হাসিনা আরও বলেন, তিনি দেশে থাকলে হয়তো আরও প্রাণহানি হতো। আরও অনেক সম্পদহানি হতো। ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনা আগামী সপ্তাহে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। শেখ হাসিনা তাঁর বার্তায় দেশে ফিরে আসার অঙ্গীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি শিগগিরই ফিরব, ইনশা আল্লাহ। পরাজয় আমার, কিন্তু জয়ী হয়েছে বাংলাদেশের জনগণ। আমি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি। আপনাদের সমর্থন নিয়ে আমি এসেছিলাম, আপনারা ছিলেন আমার শক্তি। আপনারা যখন আমাকে চাননি, তখন আমি নিজে থেকে সরে গেছি, পদত্যাগ করেছি। আমার যেসব কর্মী সেখানে (দেশে) আছেন, তাঁরা কেউ মনোবল হারাবেন না। আওয়ামী লীগ বারবারই উঠে দাঁড়িয়েছে।’ সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেছেন, তাঁর বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, তিনি তরুণ শিক্ষার্থীদের আবার বলতে চান, তিনি কখনোই তাঁদের রাজাকার বলেননি। তাঁর কথাগুলো বিকৃত করা হয়েছে। একটি গোষ্ঠী ফায়দা নিয়েছে।
জয় বলেছেন মা পদত্যাগ করেননি, হাসিনা বললেন ভিন্ন কথা: গত ৫ আগস্ট সকালে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন কি না, সেই বিষয়ে শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। জয় একদিন আগে বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়ার আগে তার মা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেননি। কিন্তু গতকাল রোববার ভারতীয় দৈনিক ইকোনমিক টাইমসকে শেখ হাসিনা বলেছেন, আমি পদত্যাগ করেছি। তাদের এই পরস্পরবিরোধী বক্তব্য নিয়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। ইকোনমিক টাইমসকে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘‘আমাকে যাতে লাশের মিছিল দেখতে না হয়, সেজন্য আমি পদত্যাগ করেছি। তারা ছাত্রদের লাশ নিয়ে ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি তা করতে দিইনি। আমি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছি।’’
সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেছেন, ‘‘আমি যদি দেশে থাকতাম, তাহলে আরও প্রাণহানি ঘটতো, আরও সম্পদ ধ্বংস হয়ে যেত। যে কারণে আমি দেশ ত্যাগ করার মতো অত্যন্ত কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আপনারা আমাকে বেছে নিয়েছেন বলেই আমি আপনাদের প্রধানমন্ত্রী হয়েছি। আপনারাই আমার শক্তি।’’ কিন্তু মাত্র একদিন আগে তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘আমার মা কখনই আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করেননি। তিনি পদত্যাগ করার সময় পাননি।’’ ‘‘তিনি একটি বিবৃতি দেওয়ার এবং পদত্যাগ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু তার আগেই বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে পদযাত্রা শুরু করে। আর তখন সময় ছিল না। এমনকি আমার মা ব্যাগ গোছাতেও পারেননি। সংবিধান অনুযায়ী, এখনও তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।’’ পদত্যাগের বিষয়টি ছাড়াও রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তনের বিষয়েও মা-ছেলের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য পাওয়া গেছে। গত ৫ আগস্ট বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জয় বলেছিলেন, ‘‘তার মা আর রাজনীতিতে ফিরবেন না। তিনি এতটাই হতাশ যে, কঠোর পরিশ্রম করার পরও সবাই তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল।’’ সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, তার মা ৪ আগস্ট থেকে পদত্যাগ করার কথা ভাবতে শুরু করেছিলেন এবং পরে পরিবারের সদস্যদের চাপের মুখে নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে দেশ ছেড়েছেন।
গতকাল রোববার ইকোনমিক টাইমসকে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর রহমতে আমি শিগগিরই (বাংলাদেশে) ফিরে আসব। আওয়ামী লীগ বারবার উঠে দাঁড়িয়েছে।’’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির মুুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। ওই দিন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেন, শেখ হাসিনা তার পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন এবং দেশে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠন করা হবে। পরে শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠন করা হয়।
আমি শিগগিরই দেশে ফিরব: দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার পর গত ৫ আগস্ট ছাত্র ও জনতার রোষের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর তিনি ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে পালিয়ে যান। গণভবন থেকে পালানোর আগে জাতির উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দিতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ছাত্র জনতা তার বাড়ির কাছে পৌঁছে যাওয়ায় সেই সুযোগ পাননি। এরবদলে নিরাপত্তাবাহিনী তাকে দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে ৪৫ মিনিট সময় বেঁধে দেয়। তবে দেশ ছাড়ার আগে শেখ হাসিনা নাকি বলে গেছেন তিনি আবারও দ্রুত ফিরে আসবেন। হাসিনার এক ঘনিষ্ট সহযোগী ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস নাউকে এ তথ্য জানিয়েছেন। হাসিনা বলেছেন, “আশা হারাবেন না। আমি শিগগিরই ফিরে আসব। আমি হেরে গেছি কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ জিতেছে। যাদের জন্য আমার বাবা ও পরিবার নিহত হয়েছে।”