আইকন ডেস্ক: দেশে অবস্থান করা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনের নির্দেশনা দিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে দেয়া এক বার্তায় তিনি বলেন, আপনাদের কাছে আবেদন জানাই যথাযথ মর্যাদার সাথে ভাবগম্ভীর পরিবেশে জাতীয় শোক দিবস ১৫ আগস্ট পালন করুন। বঙ্গবন্ধু ভবনে পুষ্পমাল্য অর্পণ ও দোয়া মোনাজাত করে সকলের আত্মার মাগফেরাত কামনা করুন।
গতকাল মঙ্গলবার (১৩ আগস্ট) দিনব্যাপী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাধিক রাজনৈতিক পেইজ ও আওয়ামী লীগের কর্মীদের ফেসবুক ওয়ালে নিন্মোক্ত বার্তাটি ভাইরাল হয়। যদিও এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ভাইরাল এই বার্তাটির সত্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
দেশবাসীর উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনার আবেগঘন খোলা চিঠিটি নিন্মরূপ-
অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আজ আপনাদের কাছে এই খোলা চিঠিটি লিখছি। বাংলাদেশের সীমানার বাইরে থাকলেও আমার প্রতিটি মুহুর্তের সকল অনুভব বাংলাদেশকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। আমার হাতঘড়িতে এখনও বাংলাদেশের সময়ই ধরে রেখেছি।
যে বাংলাদেশকে অক্লান্ত পরিশ্রম আর নিরলস চেষ্টায় আমরা সকলে মিলে একটি উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে উন্নীত করেছিলাম, সেই দেশ আজ আবারও এক অনিশ্চিত দুঃসময় অতিক্রম করছে।
সাধারণ একটি ছাত্র আন্দোলনের আড়ালে যে কত ভয়ংকর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল তা আজ সকলের নিকটই পরিস্কার৷ প্রথম থেকেই একটি গোষ্ঠীর লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করা৷ আর সেই অপরাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য সাধারণ মানুষকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তারা কোটা সংস্কার আন্দোলনের ভনিতা করে গেছে।
সে কারণেই কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সকল দাবি পূরণের পরেও তারা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। একদিকে নয় দফা দাবি মেনে নেয়ার জন্য আল্টিমেটাম দিয়েছে, অপরদিকে দাবি পূরণের জন্য আলোচনা করতে চাইলে সেই আহবান প্রত্যাখান করেছে। আল্টিমেটামের সময় অতিবাহিত হবার আগেই তাদের নয় দফা দাবি পূরণ হতে যাচ্ছে- তা বুঝতে পেরে তড়িঘড়ি করে লংমার্চের তারিখ একদিন এগিয়ে এনে তারা সরকার পতনের একদফা দাবির ঘোষণা দেয়৷
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করাই যে তাদের মূল লক্ষ্য ছিল, এই কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তা এখন সকলের কাছে সুস্পষ্ট৷ আক্ষেপ হয় এই ভেবে যে- শুরু থেকেই যদি এই আন্দোলনকে সরকার উৎখাতের আন্দোলন হিসেবে জানানো হতো, তাহলে হয়তো অনেক সাধারণ ছাত্রই এই আন্দোলনে আসতো না৷
নিরপরাধ মানুষ, দৃপ্ত তরুণ, আর নিষ্পাপ শিশুদের প্রাণ যেতো না৷ ধ্বংস হতো না দেশের অবকাঠামো৷ প্রাণ যেতো না আমাদের অকুতোভয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের৷
একটি সাধারণ ছাত্র আন্দোলনের নামে বাংলাদেশের সকলের সাথে প্রবঞ্চনা করা হয়েছে৷ সরকার উৎখাতের সাথে সাথে ধানমণ্ডি স্মৃতি জাদুঘরে আগুন দেয়া, সারা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু সংক্রান্ত সকল ভাস্কর্য ও স্থাপনার ওপর হামলা থেকে পরিস্কার বোঝা গেছে- এই আন্দোলনের পেছনের শক্তি কারা৷
আওয়ামী লীগ সরকার চেষ্টা করেছিল দেশবাসীকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানাতে, বঙ্গবন্ধুকে কো্নাে দলের নয় বরং সমগ্র জাতির গর্বের প্রতীক হিসেবে স্থাপন করতে এবং মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী স্লোগান “জয় বাংলা” কে অমর করে রাখতে৷ অথচ আজ বাঙালি জাতির মুক্তির স্লোগানকে ব্রাত্য করা হয়েছে৷ বঙ্গবন্ধুর ছবি, নাম, স্মৃতিচিহ্ন কাদের কাছে অসহ্য, তা দেশবাসী জানে৷
আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে নেই, এতে আমার কোনো দুঃখ নেই৷ আমি জানি এবং বিশ্বাস করি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অতীতেও যেমন বারবার ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে, ঠিক তেমনই আবারও নিজ শক্তিতে বলীয়ান হয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।
কিন্তু দুঃখে হৃদয় বিদীর্ণ হয় এই ভেবে যে- আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশকে যে স্বাধীনতাবিরোধী পাকিস্তান পন্থী পুরোনো শকুনের ছোবল থেকে আগলে রাখতে চেয়েছিল, তাদের অনুপস্থিতিতে সেই পিশাচদের নখর আজ সারাদেশের উপর থাবা বসিয়েছে। আজ সারাদেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তাদের বাড়িঘর লুট হচ্ছে, জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে বসতভিটা, খুন হয়েছেন আমাদের অনেক নেতাকর্মী।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জীবন আজ বিপন্ন ও অনিশ্চিত৷ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িকতার নীতিতে যাদের বিশ্বাস নেই- তারাই আজ হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দিরে আগুন দিচ্ছে, ভাঙচুর করছে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের গীর্জা, লাঞ্চিত হচ্ছেন পাহাড়ের শান্ত নিরুপদ্রব মানুষেরা। আমি দেখেছি কী নৃশংসভাবে একের পর এক থানায় আক্রমণ করে, আগুন দিয়ে, লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে অগণিত পুলিশ সদস্যকে। এইসব পুলিশ সদস্যরা কেবলমাত্র রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করছিল জনগণের জান ও মাল রক্ষার্থে, কোনো দলীয় রাজনীতির অংশ তারা নয়৷
তবুও আন্দোলনের শুরু থেকেই তারা ইট-পাথর আর লাঠিপেটার শিকার হয়েছে, তাদের গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে, ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশকে হেনস্তা করা হয়েছে, কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, থানার ভেতরে ঢুকে পুলিশের ওপর হামলা করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে৷
পুলিশের ওপর আক্রমণ করা, অস্ত্র লুট করা, কারাগার ভেঙে জঙ্গিদের বের করে আনা; এমন নৃশংস জঙ্গি কার্যক্রম বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়৷ গত পনের বছরে বাংলাদেশ থেকে সফলভাবে জঙ্গিবাদ দমন করে সুস্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আনয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখার কারণেই কী বাংলাদেশ পুলিশকে এভাবে ধ্বংস করে দেয়া হল? এই নিরীহ পুলিশ সদস্যদের অসহায় পরিবারকে জাতি কী জবাব দেবে?
আমাকে এক বস্ত্রে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছ, তাতে গ্লানিবোধ হয়েছে, কিন্তু দুঃখ নয়৷ হৃদয় রক্তাক্ত হয়েছে- যখন ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটিকে দাউদাউ আগুনে জ্বলতে দেখেছি।
ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের এই বাড়ি কেবল একটি স্মৃতি জাদুঘর নয়, এই বাড়ি বাংলাদেশের সূতিকাগার। এখানেই বাংলাদেশের জনগণের প্রিয় ‘শেখ সাহেব’ স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন এবং দেশের মানুষকে সাথে নিয়ে সেই স্বপ্ন সত্য করেছেন।
চোখ বন্ধ করলেই আমি দেখতে পাই- আব্বা দাঁড়িয়ে আছেন দোতলার বারান্দায়, নিচে অসংখ্য মানুষ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন তাদের প্রিয় মুজিব ভাইকে একনজর দেখার জন্য৷ এই ৩২ নম্বর বাড়িটা, আমার আম্মার তিলতিল সঞ্চয় যত্ন আর কষ্টে গড়ে তোলা। এই বাড়ির ইটের গাঁথুনিতে আমাদের সব ভাইবোনের হাতের ছাপ আর কপালের ঘাম জড়িয়ে আছে। আমার সৎ নির্লোভ আব্বা-আম্মার সারাজীবনের একটি মাত্র সঞ্চয় ছিল এই ৩২ নম্বরের বাড়িটি৷
সবাই দেখেছেন কিভাবে ৩২ নম্বরের বাড়িটা পুড়ছে, ছাই হয়ে যাচ্ছে সব। আর আমি দেখেছি- বাড়ির নিচ তলায় আব্বার অফিস রুমটা, ৭৫ এর সেই কালরাতে কামালকে এখানেই হত্যা করা হয়েছিল, সেই অফিস রুমটা পুড়ে যাচ্ছে দাউদাউ করে৷
আমি দেখেছি- আমার আম্মাকে, আমাদের সাধারণ রান্নাঘর, আমাদের বারান্দায় পাতা অতি সাধারণ ডাইনিং টেবিলে আম্মার হাতের সাধারণ রান্না আমরা ভাইবোনেরা তৃপ্তি করে খেতাম, কত মানুষ আমার আম্মার হাতের রান্না খেয়েছিলেন, সেই ডাইনিং টেবিলটা আর নাই, পুড়ে ছাই হয়ে গেছে৷
জাদুঘরে জামালের বিয়ের শেরওয়ানি আর রোজীর বিয়ের শাড়িটা রেখেছিলাম স্মৃতি হিসেবে, আজ আর তা নেই৷ কামাল আর খুকুর ঘরে তানপুরাটা রোজ মুছে রাখা হতো, রোজ তাজা ফুল রাখা হতো তাদের বিছানার পাশে, শুনেছি সেসব কিছুই আর অবশিষ্ট নেই৷
টেলিভিশন সেটের সামনের বেতের চেয়ারে রাসেল বসতো, চোখ বন্ধ না করেও আজও আমি রাসেলকে দেখি, আমার ছোট্ট রাসেল, তার আর কোনো স্মৃতি আগুনের হাত থেকে রক্ষা পেলো না৷ আমার আব্বার পাইপটা, চশমাটা, আমার আম্মার শাড়িটা, আব্বা-আম্মার সেই ঘরটা, বিছানার মাথার পাশের রেডিওটা; আর কিছুই নেই সেখানে যা ছুঁয়ে মনে হবে আব্বাকে স্পর্শ করলাম, আম্মার গায়ের ঘ্রাণ পেলাম, ছোট্ট রাসেলের আদর নিলাম৷
যে কাজ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীও করেনি, যে কাজ ১৯৭৫ সালেও করার সাহস করেনি, সেই কাজই ২০২৪ সালে হলো। আমাদের স্বজনহারা দুই বোনের শেষ স্মৃতির ঘরটাও আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দিলো।
এই খোলা চিঠি আমি কোনো রাজনৈতিক নেত্রীর স্থান বা প্রধানমন্ত্রীত্বের দাবি থেকে লিখছি না। এই চিঠি একজন মেয়ের চিঠি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় মেয়ে শেখ হাসিনার চিঠি৷ প্রতি বছর ১৫ আগস্ট আমার আব্বা-আম্মা, ভাই আর আত্মীয়-স্বজনদের মৃত্যুবার্ষিকীতে আমি রোজা রাখি, ফাতেহা পাঠ করি, আমার আব্বা-আম্মা আর স্বজনদের কবর জিয়ারত করে তাদের জন্য দোয়া করি।
ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের সামনে দাঁড়িয়ে সব রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতার আড়ালে আমার আব্বার মুখটা মনে করি, আম্মার স্পর্শটা অনুভব করি, রাসেলের প্রিয় ‘হাসু আপা’ হয়ে দুই মিনিট নীরবে দাঁড়াই আমাদের ছোট্ট বাড়িটার সামনে৷
দেশে থাকলে পুড়ে ধ্বংসস্তূপ হওয়া সেই বাড়ির সামনেই আমি দাঁড়াতাম আগের মতোই৷ দেশ ছেড়ে আমি যেতে চাইনি, আমি বলেছিলাম- আমাকে আব্বার কবরেই ঠাঁই দেয়ার জন্য, কিন্তু সে সুযোগও আমাকে দেয়া হয়নি। আমি আজ দেশে নেই, কিন্তু আপনারা আছেন, আমার লক্ষ লক্ষ ভাই-বোনেরা আছেন।
আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ- আগামী ১৫ আগস্ট আমার হয়ে, জাতির পিতার পরিবারের হয়ে আপনারা ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির সামনে যান, আমার পরিবারের প্রাণ হারানো স্বজনদের জন্য দোয়া করতে যান। যার যার অবস্থান থেকে আমার আব্বা-আম্মা, ভাই আর স্বজনদের আত্মার মাগফেরাতের দোয়া করেন। আমার আব্বার কবরে যে ফুলের পাপড়ি আমি দিতে পারছি না, আমার হয়ে আপনারা সেই দায়িত্ব নিন৷
আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসেবে আপনাদের প্রতি এই আহবান জানাচ্ছি; যে যেখানে দেশের যে প্রান্তেই থাকুন না কেনো, আগামী ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে স্মরণ করুন, প্রতিবাদ জানান বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি মুছে দেবার সকল প্রক্রিয়ার প্রতি, রুখে দিন সকল অপরাজনৈতিক চক্রান্ত। শোক দিবসের অশ্রুকে আমাদের শক্তিতে পরিণত করুন৷ ন্যায় ও সংগ্রামের আমরা পথে নিশ্চয়ই কখনও পরাজিত হব না৷