November 23, 2024, 1:21 pm

রাজশাহীতে ট্রেনের আদলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

রাজশাহীতে ট্রেনের আদলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

নিজস্ব প্রতিবেদক: ট্রেনের আদলে বিদ্যালয়টির নাম ধাদাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টি রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলায়। বাস্তবে বিদ্যালয়ে কোন রেলগাড়ি নেই। তবে ১৯৬৭ সালে নির্মিত চারটি কক্ষকে রং-তুলির আঁচড়ে সম্প্রতি রেলগাড়ির রূপ দেওয়া হয়েছে। এর একটি গ্রন্থাগার, অন্য তিনটি শ্রেণিকক্ষ। এই শ্রেণিকক্ষ ভীষণভাবে উপভোগ করছে শিক্ষার্থীরা।

অথচ কয়েকবছর আগেই এই ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। তখন ইটের দেয়াল আর টিনের ছাউনির সেই ঘরে ক্লাস করতে মন খারাপ হতো শিশুদের।

এখন শুধু পরিত্যক্ত এই ভবনটি শিশুদের কাছে আকর্ষণীয়ই হয়ে ওঠেনি। প্রধান শিক্ষক দিলরুবা খাতুনের হাতের ছোঁয়ায় পুরো স্কুলটিই বদলে গেছে। পরিপাটি করে সাজানো-গোছানো এ স্কুলে এখন ঝরে পড়ার হার শূন্য। এর স্বীকৃতি হিসেবে ২০২২ সালে জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয় নির্বাচিত হয়েছে স্কুলটি। রেলগাড়ির আদলে পুরনো ভবনটিকে সাজিয়ে তোলার ছবি ছড়িয়ে পড়লে প্রশংসায় ভাসছেন প্রধান শিক্ষক।

সোমবার (১১ নভেম্বর) স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, পুরো ক্যাম্পাসটি যেন একটি শিশুপার্ক। ফুলের বাগানে পশুপাখির ভাস্কর্য। শিশুদের জন্য আছে দোলনা। অফিসকক্ষের সামনে সুন্দর একটি মঞ্চ। ছোট্ট মাঠের পুরোটিতেই দৃষ্টিনন্দন টালি বসানো। সবগুলো শ্রেণিকক্ষই সাজানো-গোছানো। দেয়ালগুলো রঙিন ফুলে-ফলে। কাগজের ফুল দিয়ে শ্রেণিকক্ষ সাজিয়ে রেখেছে শিক্ষার্থীরাই। বিদ্যালয়ের পূর্ব দিকের পুরনো টিনশেড ভবনটিকে সাজিয়ে তোলা হয়েছে রেলগাড়ির আদলে। ভবনের ওপরে ‘কলকাকলি স্টেশন’ লেখা সাইনবোর্ড। রেলগাড়িটির নাম লেখা হয়েছে ‘জ্ঞানের আলো এক্সপ্রেস’। গন্তব্য ‘ধাদাশ টু মহাকাশ’।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দিলরুবা খাতুন বললেন, ‘বিদ্যালয় থেকে ঠিক কতদূর যাওয়া যায়, সে ভাবনায় মনে হয়েছে মহাকাশই সবচেয়ে দূরের গন্তব্য। তাই রেলগাড়ির গন্তব্য সেটিই লেখা হয়েছে।’

স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত ১৯৬৭ সালে। তখনই পুরনো এই ভবনটি নির্মিত। এর ওপরে টিন। পরিত্যক্ত ঘোষণা হলেও শ্রেণিকক্ষ সংকটে এখানেই তিনটি কক্ষে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়া হয়। রং উঠে অনেক আগেই দেয়ালগুলো মলিন হয়ে যায়। এ নিয়ে বাচ্চাদের মন খারাপ হতো। তারা প্রধান শিক্ষকের কাছে গিয়ে বলে, সামনের দুটি ভবনে ছাদ আছে, তাদের নেই। তাদের শ্রেণিকক্ষগুলোও যেন সুন্দরভাবে সাজিয়ে দেওয়া হয়। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে প্রধান শিক্ষক মিস্ত্রি ডেকে এনে রং-তুলিতে করে ফেললেন জাপানি লেখক তেৎসুকো কুরোয়ানাগির তেত্তো-চান বইয়ের সেই রেলগাড়ি-ক্লাস!

এখন তিনটি শ্রেণিকক্ষ যেন রেলগাড়ির একেকটি কামরা। এ স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মেঘা যখন জানালার পাশে দাঁড়ায়, তেত্তো চানের মতো তারও বুকটা দুমদুম করতে থাকে। এখানে পড়া মানে তেত্তো চানের মতো তারও মনে হয় সারাক্ষণ কোথাও না কোথাও থাকা। স্কুলের আঙিনার ফুল কিংবা বারান্দার টবে ঝুলন্ত পাতাবাহারের পাতাগুলো নড়ে বলে তারও মনে হয় ট্রেনটা চলছে।

যেভাবে বদলে গেল স্কুলটি

সালটা ২০১০। প্রধান শিক্ষক হয়ে আসেন দিলরুবা খাতুন। তিনি দেখেন, তিনটি ভবনের প্রতিটিই জরাজীর্ণ। শ্রেণিকক্ষের দেয়ালগুলো মলিন। ভেতরে শুধু ব্ল্যাকবোর্ড, আর চক-ডাস্টার। স্কুলের আঙিনায় বালু। গাছ নেই, ফুল নেই, সুন্দর পরিবেশ নেই। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার কম। গ্রামের মানুষ স্কুলের ভবনে মই ভিড়িয়ে ছাদে ওঠে। ধান শুকাতে দেয়। স্কুলের আঙিনায় শুকাতে দেওয়া হয় পাট। প্রধান শিক্ষক দিলরুবা খাতুন পাট শুকাতে দেওয়া এক ব্যক্তির বাড়ি গেলেন। বললেন, স্কুলের বাঁশ আছে। তিনি বাঁশ কেটে এনে দেবেন। তা দিয়ে জায়গা করে যেন পাট অন্য জায়গায় শুকাতে দেওয়া হয়।

তা শুনে লোকটি বললেন, ‘মা কী যে বলো! তুমি বাঁশ কেটে এনে দেবে কেন? আমরাই বিকল্প ব্যবস্থা করব। আর কেউ ধান-পাট শুকাতে স্কুলে যাবো না।’ সেই থেকে স্কুলের ভেতরে ধান-পাট শুকানো বন্ধ হয়ে যায়। এরপর প্রধান শিক্ষক অভিভাবকদের ডাকলেন। আব্দার করে বললেন, ‘আপনার বাচ্চাদের একটা করে স্কুলড্রেস বানিয়ে দেন না। জুতার সঙ্গে ইউনিফর্ম পরে বাচ্চারা এলে আপনারই ভাল লাগবে।’ অভিভাবকেরা সবাই রাজি হন। এখন স্কুলের বাচ্চারা সবাই পরিপাটি ইউনিফর্ম করে স্কুলে আসে। এরপর তিনি মনোযোগ দেন স্কুলটিকে সাজিয়ে তোলার কাজে। এখন স্কুলটি যেন একটা শিশুপার্ক। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই বাঁ পাশে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে চোখে পড়বে ছোট্ট একটি ‘পৃথিবী’। সেখানে মানচিত্র এঁকে মহাদেশগুলোর নাম লিখে রাখা হয়েছে। গ্রিলের সঙ্গে ছবিসহ জন মেজর, আলবার্ট আইনস্টাইন, পাবলো পিকাসো, টমাস আলভা এডিসনসহ আরও অনেকের বিখ্যাত উক্তি লেখা ফেস্টুন। একটি ফেস্টুনে প্রধান শিক্ষককে লেখা আব্রাহাম লিংকনের সেই বিখ্যাত চিঠি।

গ্রামের শিশুরা এখন পরিপাটি ইউনিফর্ম পরে স্কুলে আসে। শিক্ষকেরাও পরেন সাদা অ্যাপ্রোন। আগে স্কুলে টিফিনের সময়ই অনেক শিক্ষার্থী চলে যেত। প্রধান শিক্ষক তা বন্ধ করেন শিশুদের বুঝিয়ে। প্রতিবছরই পঞ্চম শ্রেণিতে চার-পাঁচজন শিক্ষার্থী বৃত্তি পেতে শুরু করে। শূন্যে নামে ঝরে পড়ার হার। তাই ২০২২ সালে স্কুলটি জাতীয় পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পদক পায়। চলতি বছরেও বিভাগীয় পর্যায়ে এই প্রতিষ্ঠান শ্রেষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছে। ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠানটি বৃটিশ কাউন্সিল ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে অসংখ্য পুরস্কার জিতেছে স্কুলের শিক্ষার্থীরা। মাইক্রোসফট অ্যাডুকেশন প্রোগ্রামসের মাইক্রোসফট শোকেস স্কুলের তালিকাতেও রয়েছে এ স্কুল।

আনন্দে স্কুলে আসে শিশুরা

শিশুরা আনন্দের সঙ্গেই এ স্কুলে আসে। প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতের লেখা শুরু করার জন্য প্রতিবছর ফেব্রুয়ারিতে এ স্কুলে ‘হাতেখড়ি’ অনুষ্ঠান হয়। সেদিন স্কুলের আঙিনায় বসিয়ে শিশুদের প্রথম হাতের লেখা শেখানো হয়। তাদের জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে রং পেন্সিল, খাতা, কলম, বিস্কুট ও চকলেট উপহার আসে। শিশুদের মায়েরা বাড়ি থেকে নানা ধরনের পিঠাপুলি বানিয়ে আনেন। এই পিঠা যেমন সব শ্রেণির শিক্ষার্থীরা খায়, তেমনি পিঠা খেতে আসেন গ্রামের সব বয়সী মানুষ। স্কুলে সেদিন উৎসবের আমেজ বিরাজ করে।

২০২২ সালে বৃটিশ কাউন্সিল বাংলাদেশের এই ধাদাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নেপাল, ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার স্কুলের তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নিয়ে একসঙ্গে কাজ শুরু করে। স্বাস্থ্য, পরিবেশ দূষণ ও স্থানীয় খেলাধুলা তুলে ধরার এ কাজে আনন্দ পায় শিক্ষার্থীরা। তাদের ভিডিও দেখে অন্য দেশের শিক্ষার্থীরা। তারাও বিদেশি সহপাঠীদের কার্যক্রম দেখে। ভার্চুয়াল মাধ্যমে সবার সভা হয়।

মাঠে সব শিক্ষার্থীকে বসিয়ে স্কুলে নিয়মিত স্থানীয় চিকিৎসকদের নিয়ে এসে প্রাথমিক চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে ক্লাস করানো হয়। বসানো হয় গল্পের বই পড়ার আসর। হাতের কাজ নিয়ে আয়োজন করা হয় চারুকারু প্রতিযোগিতা। চলে সমস্যা সমাধানভিত্তিক শিক্ষা, নানা বিষয়ে লিখতে দেওয়া হয় ইতিবাচক কথা। নিয়মিত আয়োজন করা হয় বিজ্ঞান মেলা। বছরে তিনটি করে তৈরি হয় দেয়ালিকা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এ স্কুলের শিক্ষার্থীরা পুরো মাঠজুড়েই জাতীয় পতাকা তৈরি করে কাগজ দিয়ে।

স্কুলটিতে ‘ভাল কাজের শিকল’ নামের একটি সহশিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। বছরের শুরুতে স্কুলটির সব শিক্ষার্থীকে একটি করে নোটবুক দেওয়া হয়। প্রতিদিন কোন শিক্ষার্থী কী ভাল কাজ করেছে তা এখানে লেখা হয়। তারপর প্রতিমাসে পড়ে শোনানো হয় শ্রেণিকক্ষে। যে শিক্ষার্থীর ভাল কাজগুলো সবচেয়ে বেশি ভাল মনে হয় তাদের দেওয়া হয় ‘খুদে আলোকবর্তিকা’ লেখা ব্যাজ। এসব কার্যক্রমের কারণে আনন্দেই স্কুলে আসে শিক্ষার্থীরা।

আছে দরিদ্র তহবিল

স্কুলের অনেক শিশুকেই কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন অভিভাবক। প্রধান শিক্ষক তাদের সহযোগিতায় গঠন করেন দরিদ্র তহবিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন, সহযোগী অধ্যাপক ড. আফরোজা খানম ও রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের সহকারী শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলমকে যুক্ত করেছেন দাতা হিসেবে। প্রতিবছর এ তহবিলে তারা ২০ হাজার করে টাকা দেন। সে টাকায় ২০ জন করে শিক্ষার্থীকে সহযোগিতা করা হয়। স্কুলের দরিদ্র ঘরের প্রতিবন্ধী এক ছাত্রীর বাড়িতে ভাল শৌচাগার ছিল না। দরিদ্র তহবিলের ২০ হাজার টাকায় ওই ছাত্রীর বাড়িতে শৌচাগার নির্মাণ করে দেওয়া হয়।

বাবা-মায়ের বিচ্ছেদের পর স্কুলের আরেক ছাত্র বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সে একবার আত্মহত্যাও করতে চেয়েছিল। কোনভাবেই তাকে স্কুলে আনা যাচ্ছিল না। প্রধান শিক্ষক তার বাড়ি যান। বলেন, ‘তোর কি লাগবে রে? কি করলে তুই স্কুলে যাবি?’ ওই ছাত্র বলে, ‘আমার ইলেক্ট্রনিক জিনিসপত্র তৈরি করতে ভাল লাগে।’ তাকে ডেকে এনে শুরু হয় বিজ্ঞানচর্চা। ওই ছাত্র উপজেলা পর্যায়ের ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে। পঞ্চম শ্রেণি উতরে সে এখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে।

এ স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ছিল আনিকা। রোল নম্বর ছিল ১। সে ছিল প্রধান শিক্ষকের খুবই প্রিয়। ২০১৯ সালে তাকে সাপে কাটে। অভিভাবকেরা তাকে গ্রামের ওঝার কাছে নিয়ে যায়। আনিকা মারা যায়। এই ঘটনায় শোকে মুষড়ে পড়ে পুরো স্কুল। প্রধান শিক্ষক সিদ্ধান্ত নেন, সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসায় গ্রামের মানুষকে সচেতন করতে হবে। তিনি শিক্ষার্থীদের জানালেন সাপে কাটা রোগীদের নিতে হয় হাসপাতালে। গ্রামের মানুষ তা কতটুকু জানে তা জানতে খুদে শিক্ষার্থীদেরই গ্রামের মানুষের কাছে পাঠালেন। তারা এসে বলল, অনেকেই জানে না যে সাপে কাটলে রোগীকে হাসপাতালে নিতে হয়। শিক্ষার্থীরা এবার একটা খাতায় লিখল সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসা কী। তারপর প্রিন্ট করে গ্রামের সব বাড়িতে বাড়িতে দিয়ে আসে। যে বাড়ির কেউ পড়তে পারে না, তাদের পড়ে শুনিয়ে আসে।

প্রধান শিক্ষক দিলরুবা খাতুন বলেন, ‘আমরা পুরস্কার পাব, সে আশায় কোন কাজ করিনি। স্কুলের জন্য বরাদ্দ হওয়া অর্থের যথাযথ ব্যবহার ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমেই আমরা এসব করেছি। সুষ্ঠু পরিকল্পনা থাকলে সব স্কুলই এভাবে কাজ করতে পারবে। প্রাথমিক শিক্ষার একটা লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীদের উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখতে উদ্বুদ্ধ করা। আমরা সেই কাজটিই করছি।’

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2024
Developed by- .:: SHUMANBD ::.