নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী রথের মেলাকে কেন্দ্র করে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে এনসিপি ও যুবদলের নামে। মেলার শুরু থেকেই একটি সংঘবদ্ধ চক্র প্রকাশ্যে চাঁদা আদায় করে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ।
বিশেষ করে ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের আলোচিত অপরাধী আলতু ও তার ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে রয়েছে ভয়ঙ্কর অভিযোগ। দীর্ঘদিন ধরে আলতু এবং তার চক্র এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আলতু শুধু একজন চাঁদাবাজই নয়, বরং সে খুন, গুম ও অস্ত্রধারী হামলার সঙ্গেও সরাসরি জড়িত। ছাত্র-জনতার মিছিলে পিস্তল উঁচিয়ে ওপেন ফায়ার করে দুইজনকে হত্যা করার দায়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার বিরুদ্ধে ‘যেখানেই দেখবেন, ধরে পুলিশের হাতে দিন’–এমন আহ্বান ছড়িয়ে পড়লেও এখন পর্যন্ত তার খোঁজ মেলেনি।
আলতু পলাতক অবস্থার মধ্যে তার ভাতিজা ‘বুদ্ধু’ রথের মেলায় চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। বুদ্ধুর প্রকৃত নাম সাদেক। সে মৃত আইয়ুব মহালদারের ছেলে।
স্থানীয়রা জানান, সে এলাকায় চরম সন্ত্রাসের মাধ্যমে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেছে। নিরীহ দোকানদার ও সাধারণ মানুষকে অহেতুক মারধর করা তার নিত্যদিনের অভ্যাস। সাদেক ওরফে বুদ্ধুর বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মাদক ও এসিড সন্ত্রাসের মামলা। আদালত তাকে ৩১ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি ঘোষণা করলেও সে বহাল তবিয়তে এলাকায় চাঁদাবাজির মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।
বুদ্ধুর নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ চক্রে রয়েছে আরও কয়েকজন সুমন, বিকি, খোকন, পিন্টু, রাসেল, শাওন, মিশর প্রমুখ। তারা রথের মেলায় প্রতিটি দোকান বসানোর জন্য ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে চাঁদা দাবি করছে। চাঁদা না দিলে দোকান বসাতে না দেয়ার হুমকি দেয়া হচ্ছে। স্থানীয় ছোট দোকানগুলো উঠিয়ে দিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত ব্যবসায়ীদের জোর করে বসিয়ে তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।
একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যবসায়ী বলেন, “আমি রথের মেলায় ফার্নিচারের স্টল দিতে এসেছিলাম। কিন্তু কিছু ছেলে এসে বলে, যুবদলকে চাঁদা না দিলে এখানে বসতে পারবে না। আবার কেউ বলছে, এনসিপির পক্ষ থেকে দিতে হবে। আমি কী করবো? বাধ্য হয়ে চাঁদা দিয়েছি।”
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও সংগঠনের প্রতিনিধিদের নাম ব্যবহার করে এ চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে রাজশাহী মহানগর ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তানভীর আহমেদ সুইট বর্তমান যুবদলের যুবনেতা বলেন, “আমার নাম ভাঙিয়ে কেউ যদি চাঁদাবাজি করে থাকে, তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। যুবদলের কেউ এই অপকর্মে জড়িত নয়।”
এনসিপির রাজশাহী মহানগর শ্রমিক উইং এর নেতা আবির হোসেন রুদ্র বলেন, “আমাদের সংগঠনের কোনো সদস্য রথের মেলায় চাঁদাবাজির সাথে জড়িত নয়। এনসিপির নাম ব্যবহার করে যারা এই কাজ করছে, আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর পদক্ষেপ চাই।”
এই চাঁদাবাজ চক্র এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে আসছে। স্থানীয়দের মতে, রাজনৈতিক পরিচয় আর পেশিশক্তির মাধ্যমে তারা প্রশাসনকেও প্রভাবিত করে থাকে। আলতু, বুদ্ধু ও তাদের অনুসারীদের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ থাকলেও, রহস্যজনক কারণে তারা আইনের আওতার বাইরে রয়ে গেছে।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের এক গোপন সূত্র জানিয়েছে, আলতু ও তার ভাতিজা বুদ্ধু একটি প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় থেকে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে, তবুও তাদের আটক বা বিচার হয়নি। এমনকি মেলাকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়েও পুলিশ প্রশাসন কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্থানীয় একজন সমাজকর্মী বলেন, “রথের মেলা আমাদের ঐতিহ্য, উৎসব আর ধর্মীয় আবেগের জায়গা। সেখানে যদি সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজির রাজত্ব কায়েম হয়, তাহলে সমাজ ও সংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রশাসনের এখনই কঠোর ব্যবস্থা নেয়া দরকার।”
এই চাঁদাবাজির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছে মেলায় ব্যবসা করতে আসা খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। দোকান বসাতে গিয়ে অতিরিক্ত চাঁদা দেয়ায় তাদের লাভ তো দূরের কথা, মূলধন ফেরত পাওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ মেলা শুরুর আগেই চলে গেছে, আবার অনেকে নিরাপত্তাহীনতার কারণে ব্যবসা গুটিয়ে নেয়ার চিন্তায় আছেন।
পুলিশ প্রশাসন এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়নি। তবে চাপে পড়ে তারা চাঁদাবাজদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
রাজশাহীর নাগরিক সমাজ, ব্যবসায়ী সংগঠন এবং স্থানীয় রাজনৈতিক সচেতন মহল দাবি তুলেছে, রথের মেলায় অবিলম্বে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক দলের নাম ভাঙিয়ে যারা এই অপকর্ম করছে, তাদেরকে শনাক্ত করে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে।
নিরাপত্তা নিশ্চিত করে উৎসবকে আনন্দময় করে তুলতে না পারলে, রাজশাহীর অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসবটি মানুষের জন্য আতঙ্কের উৎসবে পরিণত হবে এমন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন অনেকেই।
রথের মেলার নামে রাজশাহীতে এনসিপি ও যুবদল সংশ্লিষ্ট পরিচয়ে যেভাবে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাস চালানো হচ্ছে, তা শুধু আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি নয়; বরং সমাজে নৈরাজ্যের বার্তা দিচ্ছে। জনগণ এখন প্রশ্ন করছে, কে দেবে এর জবাব?