স্টাফ রিপোর্টার: পদ্মা নদীর সাড়াঘাট এলাকায় হাইকোর্টের একটি পুরনো আদেশকে ঢাল বানিয়ে ১৭ বছর ধরে অবৈধ বালু উত্তোলন করছে জাকারিয়া পিন্টু, সুলতান আহমেদ টনি ও ‘বালু দস্যু’ আবু সাঈদ খানের নেতৃত্বাধীন চক্র। তাদের তৎপরতায় নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে হার্ডিং ব্রিজ, লালন শাহ সেতু ও রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের ভিত্তি হুমকির মুখে।
অন্যদিকে, নাটোরের লালপুরে বৈধ বালু মহালের ইজারাদাররা প্রতিবন্ধকতার মুখে। প্রতিবছর প্রায় ১০ কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতির শিকার সরকার।
কীভাবে শুরু হয়েছিল এই অবৈধ কার্যক্রম? ২০০৮ সালে পরিবেশ রক্ষার নামে পদ্মা নদীর ১২টি পয়েন্ট থেকে ১০ লাখ কিউবিক ফুট বালু উত্তোলনের অনুমতি পায় তিন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান:
মেসার্স বিশ্বাস এন্টারপ্রাইজ (মালিক: সুলতান আলী বিশ্বাস, রূপপুর), মেসার্স শাওন এন্টারপ্রাইজ (মালিক: আবু সাঈদ খান, কুষ্টিয়া), মেসার্স আনোয়ারুল হক মাসুম (মালিক: কামরুন্নাহার, কুষ্টিয়া)।
তবে অনুমতির পরিমাণ ছাড়িয়ে তারা ব্যাপকভাবে নদী খনন শুরু করে। অংশীদারদের মধ্যেকার বিরোধ ও আদালতের মামলা সাময়িকভাবে কাজ বন্ধ করলেও, আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব আলম হানিফের প্রভাবে পুনরায় কার্যক্রম শুরু হয়।
এই চক্র ১৭ বছর আগের হাইড্রোগ্রাফি জরিপের আদেশকে চিরস্থায়ী লাইসেন্স হিসেবে ব্যবহার করছে, যদিও পদ্মার গতিপথ ও গভীরতা সম্পূর্ণ বদলে গেছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, ২০০ বালগেট বালুর অনুমতি থাকলেও তারা প্রতিদিন শত শত গেট বালু তুলছে। বিআইডব্লিউটিএ কর্মীরা চোখ বন্ধ করে দায়িত্ব পালন করছেন। যেখানে নদী ছিল, সেখানে এখন ফসলের মাঠ, আর যেখানে বসতবাড়ি ছিল সেখানে গড়িয়েছে নদী।
হার্ডিং ব্রিজ ও লালন শাহ সেতুর ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প (মাত্র ৩-৪ কিলোমিটার দূরে) ভূমিধসের ঝুঁকিতে। নদীর গতিপথ পরিবর্তনে বাড়ছে বন্যা ও ভাঙনের আশঙ্কা।
গত সপ্তাহে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর ঈশ্বরদী প্রশাসন ক্ষণিকের জন্য অভিযান চালালেও গত ৩ জুলাই থেকে পুনরায় সক্রিয় হয় চক্রটি।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসন ইচ্ছাকৃতভাবে নিষ্ক্রিয়। চক্রটির সদস্যরা বিএনপি-আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে যোগসাজশ করছে। সাংবাদিক ও স্থানীয়দের হুমকি-ধামকি দিচ্ছে ও প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত রাখছে।
নাটোরের লালপুরের দিয়ার বাহাদুর বালু মহাল (সরকারি রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস) ইজারাদাররা চরম ক্ষতির শিকার। জানা যায়, গত বছর রাসেল এন্টারপ্রাইজ ইজারা নিলেও অবৈধ বালু উত্তোলনের কারণে টাকা জমা দিতে ব্যর্থ হয়ে মামলার শিকার হয়। এবার মোল্লা এন্টারপ্রাইজ ১০ কোটি টাকায় ইজারা নিলেও চক্রটি তাদের কার্যক্রমে বাধা দিচ্ছে, মাঝি-মাল্লাদের ওপর হামলা ও মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। স্পিডবোর্ডে অস্ত্রের মহড়া দিয়ে ব্যবসায়ীদের ভয় দেখানো হচ্ছে।
মোল্লা এন্টারপ্রাইজের মালিক বলেন, এভাবে চললে ভবিষ্যতে কেউ ইজারা নেবে না। প্রশাসনকে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।
এলাকাবাসীর দাবি,অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করে ড্রেজার ও যন্ত্রপাতি জব্দ করা হোক।জাকারিয়া পিন্টু, আবু সাঈদ, টনি বিশ্বাস ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক।হার্ডিং ব্রিজ, লালন শাহ সেতু ও রূপপুর প্রকল্পের জরুরি সুরক্ষা নিশ্চিত করা হোক।নতুন হাইড্রোগ্রাফি জরিপ চালিয়ে নদীর গতিপথ পুনর্নির্ধারণ করা হোক।
স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, “নদী যাবে, সেতু যাবে, তারপর আমাদের ঘরবাড়ি, চোখের সামনে সব ধ্বংস হচ্ছে, কিন্তু প্রতিবাদ করলেই হামলার ভয়।
পরিবেশবিদ ও প্রকৌশলীরা জানান, এখনই ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী।