নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহী মহানগরীর সপুরা এলাকার সুখান দীঘি। ব্রিটিশ আমলের এ দীঘিতে এখনো থইথই পানি। একসময় ওই এলাকার মানুষের পানির প্রধান উৎস ছিল এ দীঘি। ২০২২ সালের ৮ আগস্ট এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে মহানগরীর ৯৫২টি পুকুর-দীঘি সংরক্ষণে নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। কিন্তু আদালতের এ নির্দেশনা কানে তোলেনি সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসন। এ সুযোগে আবারও থাবা বসিয়েছে ভূমিদস্যুরা। গভীর রাতে বালু ফেলে দীঘি ভরাট করা হচ্ছে। এরই মধ্যে দীঘির বেশ কিছু অংশ ভরাট করে মার্কেট নির্মাণও করা হয়েছে।আদালতের নির্দেশনার বিষয়ে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, এর আগেও সুখান দীঘি কয়েক বার ভরাটের চেষ্টা করা হয়েছিল। আমি ৩-৪ বার ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে বন্ধ করেছি। তবে নতুন করে ভরাটের খবর জানতাম না। এখন শুনলাম। আজকেই আমি ম্যাজিস্ট্রেট পাঠাচ্ছি।স্থানীয়রা জানায়, মহনগরীর সপুরা এলাকায় ১০ বিঘা আয়তনের এ দীঘিটি কয়েক দিন ধরে ভরাট করা হচ্ছে। প্রথমে রাতে বালু ফেলা শুরু হলেও এখন প্রকাশ্যেই ভরাট করা হচ্ছে। ভূমিদস্যুদের হাত থেকে দীঘিটি রক্ষায় মালিকরা আদালতের শরণাপন্ন হন। মঙ্গলবার থেকে নিষেধাজ্ঞাও জারি করেন আদালত। জিল্লুর রহমান (৬০) নামের এক ব্যক্তি জানান, এটি ব্যক্তিমালিকানার দীঘি। এখন তিনিসহ এর ওয়ারিশ অন্তত ১৫০ জন। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের জন্য দীঘিটি মাছচাষ করতে ইজারা দেওয়া হয়েছিল। ১৫ নং ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক সোহরাব আলী, ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুস সোবহান লিটন, মোস্তাক আহমেদ ও শাহিন হোসেনসহ ১০ জন ব্যক্তি দীঘিটি মাত্র দেড় লাখ টাকায় ইজারা নেন। এরপর তারা আর দীঘির দখল ছাড়েননি। উল্টো দুই কোটি টাকা না দিলে তারা দীঘি ছাড়বেন না বলে ঘোষণা দেন। এরা প্রভাবশালী বলে তারা কিছু করতেও পারেননি। এখন তারাই দীঘিটি ভরাট করছেন। এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন গোদাগাড়ীর মাটিকাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা সোহেল রানা।চেয়ারম্যান সোহেল রানা বলেন, ওই এলাকায় আমার বাসা আছে। সেখানে আমি যাতায়াত করি। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সোহরাব আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেই দীঘি ভরাট করে মার্কেট করছে। আমি ভরাটের সাথে জড়িত নই।স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুস সোবহান লিটন বলেন, ‘দীঘি-পুকুর ভরাটে আদালতের নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা সুখান দীঘি ভরাট করে ফেলছে। আমি বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। এ কারণে আমার কথা প্রশাসনও শুনছে না। তবে অভিযোগের বিষয়ে জানতে মোবাইল ফোনে দুপুর ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া দেননি সোহরাব আলী।আদালতের নিষেধাজ্ঞা ভেঙে সুখান দীঘি ভরাটের বিষয়ে জানতে চাইলে মহানগরীর বোয়ালিয়া ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহীন মিয়া বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিল না। সরেজমিনে লোক পাঠিয়ে দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।জানা যায়, মহানগরীতে একের পর এক পুকুর-দীঘি ভরাট হয়ে যাচ্ছে দেখে সিটি করপোরেশন ২২ টি পুকুর-দীঘিকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যক্তিমালিকানায় থাকলেও পুকুর-দীঘিগুলোকে অধিগ্রহণ করার পরিকল্পনা সিটি করপোরেশনের। এ জন্য একটি প্রকল্প প্রস্তুত করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এই তালিকায় আছে সুখান দীঘি। এর মধ্যেই ভূমিদস্যুরা সুখান দীঘি ভরাট করতে শুরু করেছে। এর আগে গত বছর একদফায় দীঘির কিছুটা অংশ ভরাট করা হয়। সে সময় গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে বিষয়টি নজরে আসে পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবির) নামের একটি সংগঠনের। এ নিয়ে সংগঠনটি উচ্চ আদালতে রিট করে। গত বছরের আগস্টে এই রিট আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি হয়। সেদিন উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চ রাজশাহী শহরের ৯৫২টি পুকুর সংরক্ষণের পাশাপাশি সুখান দীঘিকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেন। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) মেয়র, রাজশাহী পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসককে এই নির্দেশ দেন আদালত। তবে সুখান দীঘি রক্ষার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।শহরের ৯৫২টি পুকুর-দীঘি সংরক্ষণের এবং সুখান দীঘি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে উচ্চ আদালতের নির্দেশের বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি করর্পোরেশনের সচিব মো. মশিউর রহমান বলেন, আদেশের কোনো কাগজপত্র আমি দেখিনি। কাগজপত্র পেলে ব্যবস্থা নিতাম।সিটি করর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর ইসলাম তুষার বলেন, দিন দিন তো সব পুকুর-দীঘিই ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য ২২টি পুকুর-দীঘি সংরক্ষণের জন্য তালিকা করে একটি প্রকল্প আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। এর মধ্যে সুখান দীঘিও আছে। প্রকল্পটি সবুজ পাতায় আছে, কিন্তু পাস হয়নি। প্রকল্পটা পাস হয়ে গেলে আমরা দীঘিটা অধিগ্রহণ করে নিতাম।