তানোর প্রতিনিধি: রাজশাহী-৪ আসনের আওয়ামী দলীয় সাংসদ ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হকের বিতর্ক পিছু ছাড়ছেই না। এতে তিনি অনেকটা অস্বস্তিতে রয়েছেন। আবার আওয়ামী লীগে অসন্তোষ ও নেতাকর্মীদের মাঝেও বাড়ছে ক্ষোভ বলে মনে করছেন তৃণমুলের নেতাকর্মীরা। তাকে যেনো এবার দলীয় মনোনয়ন দেয়া না হয় তার জন্য ইতমধ্য দলের আদর্শিক ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা দলের নীতিনির্ধারণী মহলে নালিশ করেছেন। কারণ তাকে মনোনয়ন দেয়া হলে আওয়ামী লীগের বড় অংশ দলের বিপক্ষে অবস্থান নিবে। এতে আওয়ামী লীগের আসন হারানো প্রায় নিশ্চিত।
স্থানীয় সুত্র জানায়, বিগত বছরে সংসদ সদস্য এনামুল হকের গোপনে দ্বিতীয় বিয়ে এবং হঠাৎ ছাড়াছাড়ি নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে প্রথম শ্রেণীর একাধিক গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছিল এবং ঘটনা মামলা পর্যন্ত গড়িয়েছিল। ফেসবুকে একের পর এক পোস্ট দেওয়া এবং কোটি টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ তুলে সাবেক স্ত্রী লিজার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছিল। মামলায় লিজাকে সংসদ সদস্য এনামুল হকের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল।
অপরদিকে লিজা নিজেকে সাংসদ এনামুলের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে দাবি করে গণমাধ্যমে বলেছিলেন, তিনি কোনো কাগজ পাননি। তিনি প্রকাশ্যে স্ত্রীর মর্যাদা দাবি করায় সংসদ সদস্য সাহেব বিষয়টা অস্বীকার করেছিলেন। ফলে তিনি পরিস্থিতির শিকার হয়ে ফেসবুকে তাদের অন্তরঙ্গ ছবিসহ বেশ কিছু প্রমাণ প্রকাশ করেছিলেন। কারণ, তিনি সংসদ সদস্য সাহেবের রক্ষিতা নই, বিয়ে করা বৈধ স্ত্রী। সাংসদের সাবেক স্ত্রী লিজার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল ২০১৩ সালে তাঁদের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং ২০১৮ সালের ১১ মে তাঁদের রেজিস্ট্রি বিয়ে হয়। এরপর পারিবারিকভাবে তাঁদের বিয়ে হয়।
এবিষয়ে সাংসদ ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বিয়ের বিষয়টা সত্য। দুবছর আগে দশ লাখ টাকা দেনমোহরে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। দেনমোহরের টাকাও পরিশোধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘বিয়ের পর বুঝতে পারি আমি লিজার চাঁদাবাজি ও ব্ল্যাকমেইলের শিকার। সে বিভিন্ন সময় আমার নাম ভাঙিয়ে তদবির চাঁদাবাজিও শুরু করে। একটা এনজিও করে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তাকে এসব কাজ থেকে বিরত থাকতে বলায় সে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে ব্ল্যাকমেইল করতে নানা রকম ছবি ফেসবুকে আপলোড করেছিল। অবশেষে বাধ্য হয়ে গত ২০২০ সালের ২৩ এপ্রিল তাকে আইনসম্মতভাবে ডিভোর্স দিয়েছেন।
অপরদিকে প্রতারণার মাধ্যমে জীবন নষ্ট করা, স্ত্রীর স্বীকৃতি পাওয়া ও গর্ভের বাচ্চা নষ্টের বিচার চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আরজি জানানোর কথা বলেছিলেন লিজা। জীবন নিয়ে সংশয়েও আছেন বলে দাবি করেছিল লিজা। এই বিতর্কই শুধু নয়, তিনি তিন দফা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও প্রতিবারই নিয়োগ বাণিজ্য, বিএনপি-জামায়াতিদের পুনর্বাসন ও জঙ্গিদের দলে ঠাঁই দেওয়া নিয়েও একের পর এক বিতর্কে জড়িয়েছেন সাংসদ এনামুল বলে আলোচনা রয়েছে।
সুত্র জানায়,রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ২০১৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৫০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘দপ্তরি কাম নৈশপ্রহরী’ পদে ৫০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগের জন্য তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু প্রার্থী নির্বাচনে কমিটির কোনো ভূমিকা ছিল না। সংসদ সদস্য এনামুল হক নিয়োগের আগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে একটি ডিমান্ড অর্ডার (ডিও) লেটার পাঠাতেন। কোন প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে হবে চিঠিতে তার উল্লেখ থাকত। সে তালিকা ধরেই প্রার্থী নিয়োগ দিতে বাধ্য হয়েছে কমিটি।
অভিযোগ আছে, নিয়োগ দেওয়ার বিনিময়ে প্রত্যেক প্রার্থীর কাছ থেকে এনামুল হক চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা করে নিয়েছেন। সে হিসাবে অন্তত দুই কোটি টাকা নিয়েছেন তিনি। অসমর্থিত একাধিক সুত্র জানায়, সেই সময়ে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিরা টাকা দেওয়ার কথা স্বীকারও করেছিলেন। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট ইউএনও এবং উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাও স্বীকার করেছিলেন যে কেবল সংসদ সদস্যের মনোনীত প্রার্থীদেরই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে এসব নিয়োগে বাণিজ্যের কথা অস্বীকার করে এনামুল হক বলেছিলেন, ‘ওই সময় দলীয় কিছু লোকের জন্য ডিও লেটার দেওয়া হয়েছে। তবে কারো কাছ থেকে অর্থ নেওয়া হয়নি। যাদের ডিও দেওয়া হয়েছে, তারা সবাই যোগ্য প্রার্থী। কিন্ত্ত আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ ছিল টাকা ছাড়া চাকরি হয়েছে এমন নজির কমই আছে। বেশির ভাগ নিয়োগ পেয়েছে জামায়াত-বিএনপির লোকজন। শুধু চাকরি নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি পদে বিএনপি-জামায়াতের লোকদেরই বসানো হয়েছিল।
এবিষয়ে যোগীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল জানিয়েছিলেন এনামুল হকের বিগত সাড়ে ১০ বছরে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাঁর মাধ্যমে কারা নিয়োগ পেয়েছেন খোঁজ নিলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। এদিকে এসব ঘটনা দীর্ঘদিন ছাই-চাঁপা থাকলেও আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে নতুন করে নির্বাচনী এলাকার প্রায় প্রতিটি মানুষের মুখে মুখে ফের আলোচনা হচ্ছে। এতে সাংসদ এনামুর হক চরম অস্বস্তিতে রযেছেন বলে ভোটারদের মাঝে আলোচনা হচ্ছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের আদর্শিক, ত্যাগী ও নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীরা বিকল্প নেতৃত্বের সন্ধানে দৌড়-ঝাঁপ শুরু করেছে বলে একাধিক সুত্র নিশ্চিত করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক জৈষ্ঠ নেতা বলেন, এবার তারা সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাকিরুল ইসলাম সান্টুকে নিয়ে নির্বাচনের স্বপ্ন বুনছেন এবং বিষয়টি ইতমধ্যে দলের নীতিনির্ধারণী মহলের কানে দেয়াও হয়েছে।
বিভিন্ন সুত্রে জানা গেছে, এবার স্বজনপ্রীতি ও নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়নের অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে রয়েছে, আওয়ামী লীগের সেসব সংসদ-সদস্য মনোনয়ন পাবেন না।
যেসব এমপি বিএনপি-জামায়াতের অনুপ্রবেশকারীদের মদদ ও প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছেন তাদের তালিকা হচ্ছে। দুর্নীতি, অনিয়ম ও জমি দখলের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে যাদের বিরুদ্ধে, তারাও পার পাচ্ছেন না। তাদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলে একাধিক সুত্র নিশ্চিত করেছে।
সুত্র আরো জানায়,জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই দীর্ঘ হচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিতর্কিত মন্ত্রী-এমপির তালিকা। শক্তিশালী বিরোধী দলের অংশগ্রহণে এবছর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ভাবনায় নিয়ে বিতর্কিতদের বাদ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে আওয়ামী লীগ। তাই মন্ত্রী-এমপিদের ব্যাপারে দেওয়া সরকারের বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টগুলো এখন গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করা হচ্ছে।সেখানে আওয়ামী লীগের একাধিক এমপির নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের চিত্র উঠে এসেছে বলেও একাধিক সুত্র নিশ্চিত করেছে।