নিজস্ব প্রতিবেদকঃ রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়রপ্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের সামনে হেভিওয়েট কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও জাকের পার্টির মেয়রপ্রার্থী থাকলেও তাদের ভোটব্যাংক নেই। নগরবাসীর ধারণা লিটনই আবারও বসতে যাচ্ছেন নগর ভবনে। তাই এই পদের ভোট নিয়ে আগ্রহ কম। তবে পাড়া-মহল্লায় দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের জন্ম দিয়েছেন কাউন্সিলর প্রার্থীরা। বর্তমান কাউন্সিলররাই আবারও কাউন্সিলর হতে চান। তবে ছাড় দিতে চান না নতুন প্রার্থীরা। এ নিয়ে হানাহানিতে লিপ্ত হয়েছেন কাউন্সিলরপ্রার্থীরা।
সিটি নির্বাচনে বর্তমান পরিষদের কাউন্সিলর এবং সংরক্ষিত নারী আসনের কাউন্সিলররা আবারও সিটি করপোরেশনে ফিরতে চান। এজন্য পরিষদের ৪০ জনই এবারও প্রার্থী হয়েছেন। ৩০টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এবং ১০টি সংরক্ষিত নারী আসনের সবাই ভোটের মাঠে। নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি। তবে বিএনপির নেতা হিসেবে পরিচিত ১৬ জন কাউন্সিলর প্রার্থী হয়েছেন। দলীয় সিদ্ধান্ত ভেঙে প্রার্থী হওয়ায় এসব নেতানেত্রীকে ‘মিরজাফর ও ‘বেইমান’ আখ্যা দিয়ে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। তারাও ভোটের মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। বর্তমান কাউন্সিলরদের বেশির ভাগ একাধিক বার নির্বাচিত। সর্বোচ্চ ৬ বার নির্বাচিত কাউন্সিলর এবারও প্রার্থী। তারা পদ আঁকড়ে থাকতে মরিয়া হয়ে ভোটের মাঠে নেমেছেন। অন্যদিকে নবীন প্রার্থীরাও ভোটারদের আকৃষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। ফলে প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে জড়িয়েছেন কাউন্সিলরপ্রার্থীরা।নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা বিরাজ করছে ৭ নম্বর ওয়ার্ডে। এই ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ নেতা জহিরুল হক রুবেল ও যুবমৈত্রী নেতা বর্তমান কাউন্সিলর মতিউর রহমান মতি লড়ছেন। সাত নম্বর ওয়ার্ডের পরিস্থিতি ক্রমেই জটিলের দিকে যাচ্ছে। মতির সঙ্গে রুবেলের দ্বন্দ্ব প্রকট। যে কোনো সময় পরিস্থিতি খারাপের দিতে যেতে পারে বলে আশঙ্কা ভোটারদের। এ নিয়ে আতঙ্কিত তারা। কাউন্সিলর প্রার্থী মতির অভিযোগ, নির্বাচনে বিজয়ী হতে প্রতিপক্ষের লোকজন এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করছেন এবং কালো টাকা ছড়াচ্ছেন। রাতে সমর্থকরা বাসায় থাকতে পারছেন না। তিনি নিজেও বাইরে থাকছেন। নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দিয়ে কোনো সুরাহা হয়নি। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রুবেল।১৯ নম্বর ওয়ার্ডেও ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। স্বস্তিতে নেই সাধারণ ভোটাররা। বর্তমান কাউন্সিলর যুবলীগ নেতা তৌহিদুল হক সুমন ও আরেক যুবলীগ নেতা আশরাফ হোসেন বাবু কাউন্সিলর প্রার্থী। কিন্তু দুজনের দ্বন্দ্ব অনেক পুরনো। গত ৩ জুন কাউন্সিলর সুমনের সমর্থকদের ছুরিকাঘাতে কাউন্সিলর প্রার্থী বাবুসহ তার তিন সমর্থক আহত হন। ছুরিকাঘাতে আহত হয়ে কাউন্সিলর প্রার্থী আশরাফ বাবু ফেসবুক লাইভে এসে প্রতিদ্বন্দ্বী সুমনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান। কাউন্সিলর সুমন পর্নোগ্রাফি মামলার আসামি। সুমনের বিরুদ্ধে বাবু নির্বাচন কমিশনে অভিযোগও করেছেন। ছুরিকাঘাতের ঘটনার পর এ ওয়ার্ডে এখনো চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। সুমন এবং বাবুর সমর্থকরা একে অপরের মুখোমুখি অবস্থানে।
২১ নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর নিযাম উল আযীমের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন গোলাম ফারুক। নিযাম সদ্য সাবেক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটনের বউয়ের ভাই। নিজেও কয়েক দফা থেকেই কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে আসছেন। এ কারণে এলাকায় তার বেশ দাপট। কিন্তু নিযামকে আর ছাড় দিতে চান না ক্ষমতাসীন রাজনীতির সাথে যুক্ত গোলাম ফারুক। তিনি মহানগর যুবলীগ সভাপতি রমজান আলীর ছোট ভাই। ফারুকও মাঠে সরব। নিযামকে ঠেকাতে মরিয়া তিনি। এরই মধ্যে এ দুই প্রার্থীর সমর্থকদের হাতাহাতির ঘটনা উদ্বেগ বাড়িয়েছে সাধারণ ভোটারদের মাঝে।
নগরীর আট নম্বর ওয়ার্ডে ত্রিমুখী সংঘর্ষের আশঙ্কা রয়েছে। বর্তমান কাউন্সিলর এসএম মাহবুবুল হক পাভেল, জানে আলম খান জনি এবং শাহিদ হাসান বারিকের সমর্থকরা মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। এরা তিনজনই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে উত্তেজনা আছে।
১১ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপির সাবেক কাউন্সিলর আবু বাক্কার কিনু এবং বর্তমান কাউন্সিলর আওয়ামী লীগ নেতা রবিউল ইসলাম তজুর মধ্যেও দ্বন্দ্ব প্রকট। এক সময় তজুও বিএনপি করতেন। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে কাউন্সিলর হয়েই আওয়ামী লীগে যোগ দেন। কেউই হারতে চান না। তাই আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে কিনু ও তজুর সমর্থকরা প্রায় মুখোমুখি অবস্থানে। ২২ নম্বর ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বর্তমান কাউন্সিলর আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হামিদ সরকার টেকন এবং মির্জা পারভেজ রিপন। টেকনের পক্ষে মাঠে নেমেছেন তার ভাই মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার, ভাগ্নে মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মীর ইশতিয়াক আহমেদ লিমন, ছোট ভাই মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক জেডু সরকার এবং ২২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেডু সরকার। অন্যদিকে রিপনের পক্ষে মাঠে রয়েছেন মহানগর আওয়ামী লীগের কৃষিবিষয়ক সম্পাদক মীর তৌফিক আলী ভাদু, তার ছেলে মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মীর তৌহিদুর রহমান কিটু, মহানগর যুবলীগের বর্তমান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান খান মনির, মহানগর ছাত্রলীগের সহসভাপতি ফজলে রাব্বি। এ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের দুটি পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নেওয়ায় চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। ২৩ নম্বর ওয়ার্ডেও রয়েছে উত্তেজনা। এ ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর মাহাতাব হোসেন চৌধুরী। তিনি রাজশাহী মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। এলাকায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদি হাসান রনির সঙ্গে তার চরম বিরোধ। রনি পুলিশের তালিকাভুক্ত ছিনতাইকারী। তার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য আইনেও মামলা চলছে।
নগরীর ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপি নেতা তরিকুল আলম পল্টু এবং সাবেক ছাত্রদল নেতা আলিফ আল মাহামুদ লুকেনের মধ্যে চরম বিরোধ রয়েছে। কাউন্সিলর পল্টু চাঞ্চল্যকর পুলিশ কনস্টেবল সিদ্ধার্থ হত্যা মামলার আসামি। এ ছাড়া ২৬, ২৮, ২৯ এবং ৩০ নম্বর ওয়ার্ডেও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে। ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে বর্তমান কাউন্সিলর শহিদুল ইসলাম পিন্টুর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আলাউদ্দিনের সমর্থকদের উত্তেজনা বিরাজ করছে। তারা দুজনেই আওয়ামী লীগ নেতা। জয়ী হতে দুজনই মরিয়া।
নির্বাচনী পরিবেশ সম্পর্কে সুশাসন বিশ্লেষক সুব্রত কুমার পাল বলেন, ভোটে সব প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। কিন্তু অনেক প্রার্থীই আচরণবিধি মানছেন না; সবাই তা দেখছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তাদের মধ্যে একটা গা-ছাড়া ভাব আমরা লক্ষ করছি। এটা দুঃখজনক। আমরা নির্বাচন কমিশনকে ‘কাগুজে বাঘ’ হিসেবে দেখতে চাই না। তারা শক্ত অবস্থান না নিলে সুষ্ঠু ভোট নিয়ে মানুষের মাঝে শঙ্কা তৈরি হবে। এ শঙ্কা দূর করার দায়িত্ব কমিশনের।
এ বিষয়ে রাসিক নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘যারা অভিযোগ দিয়েছেন তাদের অভিযোগগুলো সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তদন্ত করে তারাই আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছেন। আর কমিশন সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করেছে।’