গোদাগাড়ী
পাটের ন্যায় পরিবেশবান্ধব আঁশ জাতীয় ফসল বট পাট (বট কেনাফ) । রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলায় চাষ হয়েছে সম্ভাবনাময় আঁশ ফসল বট পাট। হুবহু পাটের মতোই । পাতা ঢেঁড়শের পাতার মত। পাটের চেয়ে এর ফলন বেশি। আঁশের রং ও খুবই সুন্দর। “কেনাফ” এই পাটের জাতটি আঞ্চলিক ভাষায় বট নাইলা বা বট পাট নামে পরিচিত। নোনা সহিষ্ণু। সেচের প্রয়োজন হয় না।
এই পাট বীজ জমিতে বপন করার পর জমিতে কোন আগাছা নাশক দিতে হয় না। এমনকি জমিতে নিড়ানি দিতে হয় না। আগাছা পাটের সাথে প্রতিযোগীতা করে বেড়ে উঠতে পারে না। এতে কৃষকের উৎপাদন খরচ অন্য পাটের চেয়ে কম হয়।যে জমিতে বোরো আবাদ করা সম্ভব নয়, সাধারণত অনাবাদি থাকে; কিন্তু বৃষ্টিতে ফসলহানি হয়, সেই জমিতে এর চাষ করেও কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে। এর নাম “কেনাফ”। কেনাফের উৎস আফ্রিকায়। বৈজ্ঞানিক নাম হিবিসকাস মালভেসি।
উষ্ণমন্ডলীয় ও অবউষ্ণ দেশগুলোতে আঁশ উৎপাদনের জন্য ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, নরসিংদী, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিরাজগঞ্জ, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, গাজীপুর, চাঁদপুর ও গোপালগঞ্জ জেলায় বট পাটের ( কেনাফ ) চাষ হলেও। এই পাটের জাতটি মূলত নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ জেলায় চাষ হয় সবচেয়ে বেশি।
গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের ফুলবাড়ী এলাকায় ১ বিঘা জমিতে বট পাট চাষ করেছে কৃষক আব্দুল করিম। কথা হয় তার সাথে। তিনি বলেন, গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি অফিসের উপ-সহকারী কৃষি অফিসার অতনু সরকার আমাকে এ পাটের বীজ সংগ্রহ করে দিয়েছে। তার কাছে বীজ পেয়েছি জৈষ্ঠ মাসে। বীজ পাওয়ার পর জৈষ্ঠ মাসেই জমিতে বীজ বপন করি। ছোট অবস্থায় জমিতে এ পাট দেখে এলাকার অনেকেই নানা ধরনের সমালোচনা করছিল। এখন জমিতে পাটের গাছ খুব ভালো হয়েছে। বর্তমানে পাট গাছ প্রায় ৭ থেকে ৮ ফিট লম্বা হয়েছে। বিঘা প্রতি ১০ – ১২ মন ফলন হবে বলে আশা করছি। আগে যারা সমালোচনা করছিল তারা এখন আমাকে বলছে আগামীতে তারাও এ পাটের চাষ করবে। আগামীতে এ অঞ্চলে বট পাটের
চাষ বৃদ্ধি পাবে।
তিনি আরো বলেন, এ পাট কেটে ওই জমিতে পেয়াজের চাষ করবো।
মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে পাটের মতো কেনাফের গুরুত্বও অপরিসীম। কেনাফ ফসলের মূল মাটির ১০ থেকে ১২ ইঞ্চি বা তার বেশি গভীরে প্রবেশ করে মাটির উপরিস্তরে সৃষ্ট শক্ত ‘পস্নাউপ্যান’ ভেঙে দিয়ে এর নিচে তলিয়ে যাওয়া অজৈব খাদ্য উপাদান সংগ্রহ করে মাটির উপরের স্তরে মিশিয়ে দেয়। ফলে অন্যান্য অগভীরমূলী ফসলের পুষ্টি উপাদান গ্রহণ সহজ হয় এবং মাটির ভৌত অবস্থার উন্নয়ন ঘটে। মাটিতে পানি চলাচল সহজ ও স্বাভাবিক থাকে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১০০ দিন সময়ের মধ্যে প্রতি হেক্টর কেনাফ ফসল বাতাস থেকে প্রায় ১৪.৬৬ টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং ১০.৬৬ টন অক্সিজেন নিঃসরণ করে বায়ুমন্ডলকে বিশুদ্ধ ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ রাখে। কেনাফ আঁশ থেকে কাগজের পাল্প বা মন্ড তৈরি করে নিউজপ্রিন্ট মিলের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার, কেনাফ খড়ি হার্ডবোর্ড বা পার্টেক্স মিলের কাঁচামাল ও চারকোল তৈরিতে ব্যবহারযোগ্য। তা ছাড়া কেনাফ খড়ি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার এবং বীজ থেকে ঔষধি গুণ সম্পন্ন তেল পাওয়া যায়।
পৃথিবীর বহুদেশে কাগজের মন্ড ও উন্নতমানের কাগজ ছাড়াও বহু মূলবান দ্রব্যসামগ্রী কেনাফ থেকে উৎপাদিত হয়। কেনাফ আঁশ পৃথিবীর বহু দেশে শিল্পজাত দ্রব্য হিসেবে কাগজের মন্ড, বোর্ড, জিও টেক্সটাইল চট, কম্বল, পেস্নন পার্টস, মোটর কার পার্টস, কম্পিউটার পার্টস, কুটির শিল্পজাত দ্রব্য- শিকা, মাদুর, জায়নামাজ, টুপি, স্যান্ডেল এবং কাপড় চোপড় জাতীয় সোফার কভার, পর্দার কাপড়, বেডশিট, কুশন কভার, সাটিং সুটিং, পাঞ্জাবি, সোয়েটার ছাড়াও বিভিন্ন কাজে ইনটেরিয়র ইনস্যুলেটর হিসেবেও এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। সাধারণত পাট গাছের পাতা জাগ দেওয়ার আগে ঝরিয়ে ফেলা দেওয়া হয়। কিন্তুু এই বট পাটের পাতা ফেলে না দিয়ে বিশেষ পদ্বতিতে গরু কে খাওয়ালে ৭ – ১০ দিনের মধ্যে ই চোখে পরার মত গো-স্বাস্থের উন্নতি হয়।
গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি অফিসের উপ-সহকারী কৃষি অফিসার অতনু সরকার বলেন, এই পাটের বীজ আমি নিয়ে আসি এবং ঈশ্বরীপুর ব্লকের ফুলবাড়ি গ্রামের দুই জন চাষিকে দেই চাষ করার জন্য। এই পাটের জাতটি খরা সহনশীল। এই পাট বীজ জমিতে বপন করার পর জমিতে কোন আগাছা নাশক দিতে হয় না এমনকি জমি নিড়ানি দিতে হয় না। আগাছা পাটের সাথে প্রতিযোগীতা করে বেড়ে উঠতে পারে না। এতে কৃষকের উৎপাদন খরছ অন্য পাটের চেয়ে কম হয়। সাধারন পাটের আশেঁর রং এত সুন্দর হয়না এবং ফলন কম হয়। ফলে কৃষক বাজার মূল্য কম পায়। এই পাটের আঁশের ফলন, চাহিদা ও বাজার মূল্য অনেক বেশি। বটপাট এই এলাকায় আগামীতে ব্যাপক হারে চাষ হবে এবং কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হবে। সোনালী আঁশের সুদিন ফিরে আসবে।