November 25, 2024, 7:41 pm

News Headline :
অবৈধ দখলদার বুলবুল-হিটলার গংদের আড়াই মাসে কয়েক লক্ষ টাকা ঘাপলা সীমাহীন দূর্নীতির পরও বহাল তবিয়তে মোহনপুরের ইউএনও আয়শা সিদ্দিকা রাজশাহীতে চাঁদাবাজি ও দখলদারত্ব বন্ধে কঠোর হুশিয়ারি যুবদল নেতা রবি’র পিকনিকের বাসে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষার্থীর মৃত্যু রাজশাহীতে কোথাও স্থাপনা করতে না পেরে শেষমেস ভাঙারির দোকানে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে প্রস্তুত আ.লীগ: নাছিম রাজশাহীতে আলু ও তেলের দাম বাড়তি রাজশাহীতে ‘সমন্বয়ক’ সোহেল রানাকে ‘ভুয়া’ বললো মহানগর ছাত্রদল প্রধান উপদেষ্টার সাথে খালেদা জিয়ার মতবিনিময় দেশের সকল ক্ষমতার মালিক হবেন জনগণ: ড. মুহাম্মদ ইউনূস
বাগমারায় তিন মাসে আড়াই হাজার বিঘা ফসলি জমি গেছে পুকুরের পেটে

বাগমারায় তিন মাসে আড়াই হাজার বিঘা ফসলি জমি গেছে পুকুরের পেটে

নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহীর বাগমারার মজিদপুরের বিলের মাঝখানে একই স্থানে কাটা হয়েছে বিশালাকার ৬টি পুকুর। মাস খানেক আগে স্থানীয় সোহেল রানা নামের এক যুবলীগ নেতা প্রায় ২শ বিঘা ধানি জমি ড্রেজার দিয়ে কেটে পুকুর করেছেন। জমিওয়ালাদেরকে বছরে ৩৫ হাজার টাকা বিঘা বন্ধক (স্থানীয় ভাষায় লিজ) দিয়ে পুকুরগুলো কেটেছেন তিনি। পুকুর খনন করতে অনেক কৃষককে বাধ্য করা হয়েছে-এমন অভিযোগও আছে। এখন সেই পুকুরে মাছচাষের জন্য পানি দেওয়া হচ্ছে পাশের গভীল নলকূপ থেকে। আগামী মাস খানেকের মধ্যে কাটা পুকুরগুলো মাছচাষের জন্য উপযোগী করে তোলা হবে। পুকুর কাটার ফলে ওই জমিগুলোতে এবার ধানচাষ করতে পারেননি কৃষকরা। অথচ পুকুরের চারিদিকে রোপন করা ধানগুলোতে এরই মধ্যে পাক ধরেছে। কোনো কোনো কৃষক ধান কাটতেও শুরু করেছেন। কিন্তু যেসব জমিতে পুকুর করা হয়েছে, সেসব জমিতে আর কখনো ধান বা অন্যান্য ফসল হবে না। যদিও ওই এলাকার কৃষকরা বছরে তিনটি ফসল ঘরে তুলতে পারতেন এসব জমি থেকে। এক কথায় বলা যায়, পুকুর কাটার ফলে কৃষি জমি হারিয়েছেন ওই এলাকার অন্তত ২০০শ কৃষক। যাঁদের মধ্যে কারো আছে ৫ শতাংস জমি থেকে শুরু করে ৬-৭ বিঘা পর্যন্ত।

অনুসন্ধানে গেছে, বাগমারার শুধু এই বিলেই নয়, গত তিন মাসে গোটা বাগমারা জুড়ে অন্তত ৫০টি বিলে আড়াই হাজার বিঘা ধানি জমি (বছরে দুই থেকে তিন ফসল হতো) কেটে কমপক্ষে আড়াইশ পুকুর করা হয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা প্রশাসনের সঙ্গে মিলে-মিশে বেশি লাভের আশায় এসব ফসলি জমিতে মাছচাষের জন্য কাটা হয়েছে এসব পুকুর। আর এ নিয়ে গোটা বাগমারাজুড়েই সাধারণ মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে ব্যাপক ক্ষোভ। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ নেতাকর্মীরা সরাসরি পুকুর কাটার কাজে জড়িত থাকার কারণে এবং প্রশাসনের নিরলিপ্ততায় এ নিয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।

মজিদপুর গ্রামের কৃষক আকবর আলী বলেন, ‘আমার জমিতেও পুকুর কাটা হয়েছে। আমি কাটিনি। যুবলীগ নেতা সোহেল রানা, পৌর যুবলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক) তিনি কেটেছেন পুকুরগুলো। এ কারণে প্রশাসন কোনো বাধা দেয়নি। পুকুর কাটতে জমি বন্ধক দিতে প্রথম দিকে অনেকেই রাজি ছিল না। পরে আবার অনেকেই রাজি হয়ে যান। এ কারণে আমিও রাজি হয়।’

ওই এলাকার আরেক কৃষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমি জমি দিতে রাজি ছিলাম না। কিন্তু আমার পাশের জমিগুলো যখন কাটা শুরু হয়, তখন বাধ্য হয়ে আমি বন্ধক দেয় বছরে ৩৫ হাজার টাকা বিঘা চুক্তিতে। আমার যে জমিতে বোরো ধানসহ বছরে তিনটা ফসল হতো, এখন সেখানে পুকুর হয়ে গেছে গত দুই মাসের মধ্যে। আমাদের বিলে পাশাপাশি ৬টি পুকুর কেটেছেন সোহেল রানা। সবমিলিয়ে অন্তত দুই বিঘা জমিতে কেটে পুকুর করেছেন তিনি একই স্থানে।’

যুবলীগ নেতা সোহেল রানাও বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘অনেক জমি পড়ে থাকত। কৃষকরাই আমাকে বছরে ৩৫ হাজার টাকা বিঘা চুক্তিতে জমি লিজ দিয়ে (বন্ধক) পুকুর কাটার অনুমতি দিয়েছেন। আমি ১১ বছর এই পুকুর ভোগ-দখন করতে পারব। তবে প্রতি বছর কৃষকদের বিঘা প্রতি চুক্তি অনুযায়ী টাকা দিতে হবে। এতে কৃষকরাও লাভভান হবেন। সে কারণেই তারা জমি দিয়েছেন আমাকে। জোর করে কারো নিকট থেকে জমি নেওয়া হয়নি।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাগমারার বিল জশায় বিলেও অন্তত ২৫টি পুকুর খনন করা হয়েছে গত তিন মাসে। এখানেই স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মিলে-মিশে পুকুরগুলো খনন করেছেন মাছচাষের জন্য। আওয়ামী লীগ কর্মী এরশাদ আলী এর মধ্যে অন্যতম। তবে এরশাদ আলী বলেন, আমি সব পুকুর তো কাটিনি। কয়েকটি কেটেছি কৃষকদের সঙ্গে চুক্তি করেই। কেউ বলতে পারবে না জোর করে পুকুর কাটা হয়েছে।’

উপজেলার বালুপাড়া বিলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মী জাবের আলীর নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি পুকুর খনন করা হয়েছে। প্রায় ১০০ বিঘা জমিতে পুকুর খনন করা হয়েছে এখানে। স্থানীয় কৃষক দেরাজ আলী বলেন, ‘আমি জমি পুকুরে দিতাম না। কিন্তু অনেকেই ভয়ভীতি দেখাইছে। পুকুর না দিয়ে জমিতে ফসল করতে দিবে না বলেও হুমকি দিছিল। তাই বাধ্য হয়ে পুকুর কাটতে অনুমতি দিছি।’
আওয়ামী লীগকর্মী জাবের আলী বলেন, ‘অনেক জমিতে বছরে শুধু একবার ধান হতো। বাকি সারা বছর পড়ে থাকতো। তাই কৃষকরা বাধ্য হয়ে জমি বন্ধক দিছেন পুকুর খননের জন্য। কারও নিকট জোর করা হয়নি।’

সরেজমিন অনুসন্ধানে ও এলাকাবাসী, স্থানীয় কৃষক এবং মাছচাষিদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া তথ্য মতে, বাগমারার বাসুদেবপুর ইউনিয়নের কয়েকটি বিলে অন্তত ১৮টি, ঝিঁকড়া ইউনিয়নের ৫-৬টি বিলে অন্তত ২০টি, মাড়িয়া বিলে ১১টি, শ্রীপুর ইউনিয়নের কয়েকটি বিলে অন্তত ১৫টি, গোয়ালকান্দি ইউনিয়নের কয়েকটি কয়েকটি বিলে ২০-২২টি, আউচপাড়া ইউনিয়নে ১৭-১৮টি, দ্বিপুরে ৮টি, বড়বিহানালী বিলে ৭টি, ভবানীগঞ্জ পৌর এলাকার তিনটি বিলে অন্তত ১৫টি, বাসুপাড়া বিলে ১৮টি, গনিপুর ইউনিয়নের কয়েকটি বিলে অন্তত ২৫টি, গোয়ালকান্দিতে অন্তত ১৭টি, খয়রা বিলে ১২টি, তেলিপুকুর-গাঙ্গপাড়া বিলে ৮টি, দুবিলা বিলে ৯টি, নাককাটি বিলে ৩টিসহ উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের অন্তত ৫০টি বিলে কমপক্ষে আড়াই হাজার বিঘা জমিতে গত তিন মাসে পুকুর খনন করা হয়েছে।

বাগমসারার স্থানীয় এক সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মাঝে কয়েকদিন স্থানীয় প্রশাসন কয়েকবার অভিযানও করে। কিন্তু প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের দাপটের কাছে তারাও পরে পেছনে সরে গিয়ে হাত মেলায়। ফলে রাজশাহীর যেসব উপজেলায় এ বছর পুকুর কাটার হিড়িক পড়ে, তার মধ্যে বাগমারাতেই সবচেয়ে বেশি পুকুর খনন করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন স্থানীয়রা। এতে করে উপজেলাতে এ বছর অন্তত আড়াই হাজার বিঘা কৃষি জমি হারিয়ছেন কৃষকরা।’

উপজেলার বড়বিহানালী এলাকার মাছচাষি আলতাফ হোসেন বলেন, ‘এ বছর প্রচুর জমিতে পুকুর খনন হয়েছে। আমরা যতটুকু জেনেছি, তাতে কমপক্ষে আড়াই-তিন হাজার বিঘা জমি গেছে পুকুরে। মাছ চাষ করে এবং জমি বন্ধক রেখে বেশি লাভের আশায় ধানের জমিগুলো পুকুর হচ্ছে। কোনো বিলে বছরে একবার বারও ধান হয়। আবার কোনো বিলে বছরে তিন ফসল হয়।’

আরেক মাছচাষি আমজাদ আলী বলেন, ‘একেকটি পুকুরের আয়তন ৭০-৮০ বিঘাও আছে। কোনো পুকুরই ১০ বিঘার নিচে নাই। হাতে গোনা অল্পসংখ্যক পুকুর হয়তো ৫-৭ বিঘা করে হবে। বাকিগুলো ১০-৮০ বিঘা বা তার ওপরেও আছে। সেই হিসেবে যদি আড়াইশ পুকুরও এ বছর হয়, তাহলে কমপক্ষে আড়াই হাজার বিঘা জমি গেছে পুকুরে।’

এসব নিয়ে জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, পুকুরের কারণে অনেক ফসলি জমি আমরা হারাচ্ছি। কিন্তু কি পরিমাণ জমি পুকরে গেছে সেই তথ্য আমাদের কাছে নাই। তবে এ বছরও শতাধিক বিঘা জমি পুকুরে চলে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও পুকুর খননের অনুমতি নাই। তার পরেও কৃষি জমিতে পুকুর খনন চলছেই। কিন্তু আমাদের কিছু করার নাই।’
বাগমারা থেকে সদস্য বদলি হয়ে যাওয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রবিউল করিম বলেন, ‘আমাদের কাছে সংখ্যা ছিল না। কিন্তু মাঠ ঘুরে যতটুকু আমি দেখে এসেছি, তাতে এক দেড় হাজার বিঘা জমিতে তখনোই পুকুরে হয়েছে। যদিও চাষিরা আমাদেরকে জানান না তারা কোথায় কোথায় পুকুর করছেন। আবার দুর্গম বিলের মাঝেও পুকুর হচ্ছে, সেসব স্থানের খবরই আমাদের কাছে থাকে না। সে কারণে সঠিক তথ্য পাওয়া মুশকিল।’

বাগমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুবুল ইসলাম বলেন, ‘পুকুর খনন রোধে কৃষকদের মাঝে সচেতনতা জরুরী। যেটা হচ্ছে না। এ কারণে অভিযান করেও পুকুর খনন থামানো যায়নি। এখানে আমি নতুন আসার পরেও অনেকগুলো পুকুর খনন হয়েছে। আমরা প্রতিদিনই অভিযান চালাচ্ছি। কিন্তু লাভ হচ্ছে না। রাতারাতি পুকুর কাটা বন্ধ করা যাচ্ছে না।’
এদিকে, বাগমারা ছাড়াও পাশের পুঠিয়াতেও গত তিন মাসে অন্তত ১০০টি, দুর্গাপুরে অন্তত ৫০টি, তানোরে অন্তত ২৫টি পুকুরে।

এসব বিষয়ে জানতে রাজশাহী জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, পুকুর খনন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ আছে। প্রশাসনও কাজ করছে। তার পরেও প্রতিদিনই রাতের আঁধারে পুকুর খনন হচ্ছে। প্রশাসন কতটা পাহারা দিবে? এর জন্য স্থানীয় এলাকাবাসীর সচেতনতা জরুরী আগে। তবেই পুকুর খনন রোধ করা যাবে।’

Please Share This Post in Your Social Media

ads



© All rights reserved © 2024
Developed by- .:: SHUMANBD ::.