স্টাফ রিপোর্টার, পাবনা
নাম মামুন রশীদ, বয়স ২৮ এর ঘরে। একজন মুদি দোকানদার। দিনশেষে যা আয় হয় তা দিয়ে কোনোমতে চলে সংসার। কিন্তু আজ তিনি সবার কাছে ‘গ্রহ মানব’ হিসেবে পরিচিত। কারণ একক নাটক অভিনয়ে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তিনি। সবার নজর কাড়ার পাশাপাশি প্রশংসায় ভাসছেন। নাটকটির নাম ‘গ্রহ মানব’।
পাবনার চাটমোহর পৌর সদরের বালুচর মহল্লার এস এম আতাহার আলীর ছেলে মামুন রশীদ। দুই ভাই আর এক বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি। আর এই নাটকটি রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন চাটমোহরের নাটকের ইতিহাসে জীবন্ত কিংবদন্তি নাট্যকার আসাদুজ্জামান দুলাল।
‘নাটক হোক নান্দনিক হাতিয়ার’ শ্লোগানে সম্প্রতি চাটমোহরের স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন ‘চেতনায় চাটমোহর’ তাদের প্রথম প্রযোজনা একক নাটক ‘গ্রহ মানব’ মঞ্চে নিয়ে এসেছে। চাটমোহর পৌর সদরের মাস্টরপাড়ায় চিত্রগৃহ চাটমোহর মিলনায়তনে গত দুই সপ্তাহে নাটকটির চারটি শো পরিবেশিত হয়েছে। দর্শণীর বিনিময়ে নাটকটি দেখে ব্যাপক প্রশংসা করেছেন দর্শকরা। সর্বশেষ গত শুক্র ও শনিবার দু’টি শো পরিবেশিত হয়।
গ্রহ মানব নাটকটি মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া প্রেম, বিরহ, হাসি, কান্না, যুদ্ধ বিগ্রহের গল্প অথবা কোনো কল্প কাহিনী নয়। মহাকালের ইতিহাস ফুঁড়ে বহু মানুষের গত-বিগত যাপিত জীবনের আঁকা-বাঁকা পথ পরিক্রমায়, যুগপৎ লড়াই-লড়াকু বেশে, হারজিত তান্ডবের ভেতর, মানুষ কি করে বড় হলো সেই দিকে তাক করা এক তীক্ষè তীর ফলা।
প্রায় ৩৫ মিনিটের মতো একক নাটকটিতে অভিনয়ে বেশ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন অভিনেতা মামুন রশীদ। সাবলীল ও ক্ষুরধার তার অভিনয়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দর্শক কয়েক সেকেন্ডের জন্যও তার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারেনি। চাটমোহরের ইতিহাসে এটাই প্রথম কোনো একক নাটক মঞ্চস্থ হলো।
অভিনেতা মামুন রশীদ একজন মুদি ব্যবসায়ী। পৌর সদরের জিরো পয়েন্ট এলাকায় মুদি দোকানে সারাদিন বেচাকেনা করে রাতে বাড়ি ফেরেন। এর মাঝেই সময় বের করে নাটকটির জন্য সময় দিয়েছেন তিনি। মাসের পর মাস রিহার্সেল করেছেন।
আলাপকালে মামুন রশীদ বলেন, ছোটবেলা থেকেই নাটকের প্রতি দুর্বলতা। ২০০৮ সালের দিকে সমন্বয় থিয়েটারের আয়োজনে প্রথম নাটকে অভিনয় শুরু তার। বাথান, লাল কাজলের পালা, বিনিময় সহ কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। ২০১১ সাল পর্যন্ত চর্চা ছিল। তারপর লম্বা একটা সময় জীবিকার তাগিদে নাটক থেকে দূরে থাকা। এরপর প্রায় এক যুগ পর আবার ফিরলাম একক নাটকে।
মামুন রশীদ বলেন, গ্রহ মানব একটা ‘র’ ধাঁচের কাজ। অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। মাঝপথে থেমেও গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আমার দ্বারা একক নাটক মনে হয় হবে না। নাট্যকার নির্দেশক আসাদুজ্জামান দুলাল, চিত্রগৃহ চাটমোহরের পরিচালক জেমান আসাদ সহ অন্যদের অনুপ্রেরণায় সাহস পাই। এগারো মাস রিহার্সেল করেছি এই নাটকটির জন্য। এখন ভাল-মন্দ দর্শকরা বলবেন।
চাটমোহরে নাটকের যেটুকু নিভু নিভু করে জ্বলছে সেটুক নিঃস্বার্থভাবে ধরে রেখেছেন জীবন্ত কিংবদন্তি নাট্যকার আসাদুজ্জামান দুলাল। তিনি বলেন, আসলে আমরা একটা অস্থির সময় পার করছি। বলা যায় সময়ের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছি আমরা। তবু আমি কখনও থিয়েটার ছেড়ে যাইনি। এখন অনেক ব্যস্ততার মধ্যে অনেককে নাটকের জন্য পাওয়া যায় না। তাই একক নাটক আনার চিন্তা করি। একজন মুদি দোকানদারকে দিয়ে সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করেছি। এগারো মাস ধরে পরিকল্পনা ও রিহার্সেল করেছি আমরা। একক নাটকের যে চ্যালেঞ্জ ছিল সেটায় আমি উৎরাতে পেরেছি বলে মনে করি।
চেতনায় চাটমোহর ও চিত্রগৃহ চাটমোহরের পরিচালক জেমান আসাদ বলেন, বিষয়টি সময়ের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধের মতো। এখন নাটক করার মতো মানুষ নেই। জীবন-জীবিকার যাতাকলে মানুষের নান্দনিকতার সময় আর সুযোগ নেই। তবুও প্রদীপ জ্বালিয়ে বসেছি, একটি স্বপ্ন নিয়ে, যদি কেউ আসে। সেই স্বপ্নের পথ বেয়ে দীর্ঘ এগারো মাসের চেষ্টায় আমরা একক নাটক গ্রহ মানব মঞ্চে আনতে পেরেছি। এর মধ্যে দর্শকের যে সাড়া পেয়েছি তাতে আমরা অভিভূত।
নাটকটি দেখতে ঢাকা থেকে এসেছিলেন ‘কাঠবিড়ালী’ সিনেমা খ্যাত পরিচালক নিয়ামুল মুক্তা। তিনি বলেন, প্রায় ৩৫ মিনিট দৈর্ঘ্যরে নাটকটিতে মামুন রশীদ অসাধারণ অভিনয় করেছেন। একজন দর্শককেও দেখলাম না যে নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে মোবাইলে ব্যস্ত থাকতে। একদম পিনপতন নিরবতার মধ্যে এক নিঃশ্বাসে নাটকটি দেখেছেন দর্শকরা। নাটক থেকে চোখ সরানোর জায়গা ছিল না। ভাল স্ক্রিপ্ট, ভাল অভিনয়, মঞ্চ সজ্জা। এক কথায় দুর্দান্ত।