November 27, 2024, 12:18 am

ভোটের আগে রাসিককে ডোবালেন ঠিকাদার!

ভোটের আগে রাসিককে ডোবালেন ঠিকাদার!

নাহিদ ইসলাম,নিজস্ব প্রতিবেদকঃ দেশের একটি প্রখ্যাত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সুপারিশে ঢাকার তানভীর কনস্ট্রাকশনকে প্রায় ২০০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ দিয়েছিল রাজশাহী সিটি করপোরেশন। কার্যাদেশ পাওয়ার পর প্রায় তিন বছর শেষ। কিন্তু অগ্রগতি মাত্র ৩০ শতাংশ। এরই মধ্যে ৪৬ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তানভীর কনস্ট্রাকশন। এর পর থেকে চলছে সম্পর্কের টানাপড়েন। এ কারণে সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের ফোনও ধরেন না ঠিকাদার। তবে ভোটের আগে এসব উন্নয়ন কাজ শেষ না হওয়ায় চটেছেন সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনও। তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রকাশ্যেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বেশি ডুবিয়েছে এই একটি ফার্মই।’

জানা গেছে, রাজশাহী মহানগরীর ৩০টি ওয়ার্ডেরই পাড়া-মহল্লার ছোট ছোট রাস্তা ও ড্রেন সংস্কার ও নির্মাণের কাজ দেওয়া হয়েছে ‘তানভীর কনস্ট্রাকশন’ নামের ঢাকার ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির হাতে। এ কাজের জন্য বরাদ্দ ১৮৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ঠিকাদার কাজ না করার কারণে ক্ষুব্ধ নগরবাসী। ভাঙাচোরা রাস্তায় দুর্ভোগ বেড়েছে তাদের। ফলে এই ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে আসন্ন

সিটি নির্বাচনে। তানভীর ইস্যুতে ভোটের আগে শঙ্কায় পড়েছেন খোদ মেয়রসহ কাউন্সিলররা।সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ থেকে জানা গেছে, ‘রাজশাহী মহানগরের সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে তিন হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ চলছে। এই প্রকল্পের আওতায় মহানগরীর সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে। এর মধ্যে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এই প্রকল্পের ভেতরেই গোটা নগরীর ড্রেন ও রাস্তা নির্মাণের জন্য ১৮৭ কোটি ৫২ লাখ টাকার কাজ দেওয়া হয়েছে তানভীর কনস্ট্রাকশনকে। ২০২০ সালের ২১ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটিকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কার্যাদেশ পাওয়ার দুই মাস পর প্রতিষ্ঠানটি কাজে হাত দেয়। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কাজের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এর পর তা বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এর মধ্যেও কাজ শেষ হয়নি। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কাজের মেয়াদ আবারও বাড়িয়ে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি মাত্র ৩০ শতাংশ। এখন কাজই বন্ধ রেখেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে তুলে নিয়েছে ৪৬ কোটি টাকা।এ প্রকল্পে মহানগরীর ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের চৌদ্দপাই এলাকায় একটি ড্রেন নির্মাণের কথা। এ ছাড়া মির্জাপুর পশ্চিমপাড়া, মির্জাপুর হিন্দুপাড়া, পশ্চিম বুধপাড়া এলাকাতেও ড্রেন ও রাস্তা নির্মাণের কথা। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বুধপাড়া এলাকার আতিকুর রহমান বলেন, ‘বছরের পর বছর আমাদের এ রাস্তাটার জন্য দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। শুনেছি ঠিকাদারকে কাজ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঠিকাদার কাজ করতে আসে না।’ একই এলাকার গৃহবধূ সাফিনা খাতুন বলেন, ‘কাউন্সিলর শুধু ভোটের সময় আসে। শুধু বলে ভোট দাও, ভোট দাও। কিন্তু এলাকার কাজতো হয় না। সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তার পানি ঘরে ঢুকে যায়’।

এ বিষয়ে ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শহিদুল ইসলাম পিন্টু বলেন, ‘আমার ওয়ার্ডে কাজের জন্য ঠিকাদারের বরাদ্দ ১০ কোটি টাকারও বেশি। এত দিন ধরে ঠিকাদার এক কোটি টাকারও কাজ করেনি। কাজ এখনো বাকি আছে, নাকি সব শেষ হয়ে গেছে সেটাও আমাকে জানানো হয় না। কাজের কাজ কিছুই হয়নি বলে এখন আমরা বিপদে আছি। এবার ভোটে এর খারাপ প্রভাব পড়তে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঠিকাদার কোনো যোগাযোগই করেন না। কাজ শেষ হলে বিল তোলার আগে কাউন্সিলরদের স্বাক্ষর দিতে হয়। বলতে হয় যে এলাকায় কাজ হয়েছে। তবে এ রকম কোনো স্বাক্ষর নেওয়ার জন্যও ঠিকাদার আসেননি।’

 

ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান তানভীর কনস্ট্রাকশন মহানগরীর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের লক্ষ্মীপুর ঝাউতলা এলাকার নুরুর বাড়ির কাছের ৩০০ মিটার রাস্তা, কলপুকুর এলাকার ১৫০ মিটার রাস্তা, আনন্দ লাইটিংয়ের কাছের ৪০০ মিটার রাস্তার কাজ করার করা কথা। কোনো কাজই হয়নি। ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুরুজ্জামান টুকু জানান, রাস্তাগুলোর কাজ না হওয়ায় এলাকার লোকের খুব কষ্ট। কাউন্সিলর হিসেবে আমারও তো খারাপ লাগে। ভোটের আগে লোকজনকে বোঝাচ্ছি যে, এর জন্য ঠিকাদার দায়ী। এবার নির্বাচিত হলে অন্য ঠিকাদারকে দিয়ে কাজ করাব।’

রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর ইসলাম তুষার জানান, দুদফা মেয়াদ বাড়িয়ে কাজ হয়েছে মাত্র ৩০ শতাংশ। কোভিড এবং কোভিডপরবর্তী সময়ে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির কারণে ঠিকমতো কাজ করা যায় না বলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন সময় অজুহাত দেখিয়েছে। এ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ৪৬ কোটি টাকা বিল পেয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানটিকে দিয়ে আর কাজ করানো যাবে না। আমরা বিকল্প ভাবছি।

তানভীর কনস্ট্রাকশনের এমন কার্যক্রমে বিব্রত রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনও। গত ১০ মে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এ বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন তিনি। মেয়র বলেন, ‘ছোট ছোট গলি পথগুলো করার জন্য প্রখ্যাত একটি প্রতিষ্ঠানের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে আমরা কাজ দিয়েছিলাম। তিন বছর আগে তাকে কাজ দেওয়া হয়েছে। বারবার তাকে বলার পরও তিনি কাজগুলো শেষ করলেন না, আমাদের জনগণের মুখে রেখে গেলেন। তাদের অনেক অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি। এখন তাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে কাজ দিলে তারা উল্টো মামলায় যাবে বলেও হুমকি দিয়ে রেখেছেন। তবে আর কোনো ছাড় হবে না। নির্বাচনের পর তানভীর কনস্ট্রাকশনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তানভীর কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ বলেন, বিটুমিন সংকটের কারণে কার্পেটিং করা যাচ্ছে না। বর্ষার আগেই কার্পেটিং হওয়ার কথা ছিল। বিটুমিনের জন্য দেশের একটি নামকরা ব্যবসায়িক গ্রুপকে চার কোটি টাকা অগ্রিম দেওয়াও হয়েছে। কিন্তু তারাও সরবরাহ করতে পারছে না। ফলে আমাদের মোটা অংকের টাকা তাদের কাছে আটকে গেছে। এ কারণে অন্তত ৫০টি সড়ক কার্পেটিং কাজ এখনো হয়নি। তবে আমাদের নিজস্ব নামে এলসি খোলা হয়েছে। শিগগির বিকল্প ব্যবস্থায় বিটুমিন আনা হবে। এছাড়া সিডিউলের চুক্তিমূল্যের তুলনায় এখন নির্মাণসামগ্রী দাম অনেক বেশি। এ কারণে কাজ ব্যাহত হচ্ছে।

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2024
Developed by- .:: SHUMANBD ::.