নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজশাহী মহানগরীতে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হাতের কবজি কেটে নেয়ার ১২ দিন অতিবাহিত হলেও মামলার প্রধান আসামি আজিজ ও তার বাহিনীকে এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ । এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছেন ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যসহ মহল্লাবাসী। আসামিরা গ্রেফতার না হওয়ায় ভুক্তভোগী পরিবার উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার মধ্যে রয়েছে বলে জানান।
এঘটনার পর থেকে রাজশাহী মহানগরের খুলিপাড়া এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।
রাজশাহী মহানগরীর খুলিপাড়া এলাকায় গত ২২শে জুন, বৃহস্পতিবার নির্বাচনী পরবর্তী সহিংসতায় হাতের কবজি কেটে নেয়াসহ আরও ৩ জন গুরুতর হয়। খুলিপাড়া এলাকার আজিজ বাহিনীর হামলায় আলতাব নামের এক ব্যক্তির হাতের কব্জি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং তার অন্য হাতও অর্ধ-বিচ্ছিন্ন করে দেয় আজিজ ও তার বাহিনীরা। পরে তাকে উদ্ধার করে রামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে পরবর্তীতে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয়।
আহতরা হলেন, নগরীর খুলিপাড়া এলাকর শুকুর আলীর ছেলে মুকুল (৪৫), বদর আলীর ছেলে আলতাব (৪৫), আনসার আলীর ছেলে মনা (২৬) ও মনিরুল ইসলামের ছেলে সজল(২৩)।
জানাগেছে, বেশ কিছুদিন থেকেই আহত ব্যাক্তিদের হামলার পরিকল্পনা করে আসছিল কিশোর গ্যাং নেতা আজিজ ও তার বাহিনীরা। তবে কিশোর গ্যাং নেতা আজিজ-বাহিনীরা ২১ নং কাউন্সিলর নিজামের লোক বলে ওয়ার্ডবাসির কাছে পরিচিত তারা। এর যথাযথ তথ্য প্রমাণ রয়েছে প্রতিবেদকের হাতে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে নির্বাচনের ২১ নং কাউন্সিলরের নিজামের জযলাভের পরে গত (২২জুন), দুপুরে কিশোর গাং আজিজ বাহিনীরা অতর্কিত হামলা চালায়। পরে ২৩ জুন হাতের কব্জি বিচ্ছিন্ন হওয়া আলতাবের ছেলে সাকিব হোসেন ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে বোয়ালিয়া মডেল থানায় মামমা রুজু করেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, টিওবয়েল মিস্ত্রী সিরাজ শেখের ছেলে আজিজ, মজিদ, হিটলার, রানা, ও মেয়ে বেলি আরেক পক্ষের ছেলে বুলবুলকে নিয়ে টিকাপাড়া এলাকায় ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করতে থাকেন। সিরাজ শেখের পৈত্রিক বসতবাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা এলাকায়। কাজের সুবাদে তারা খুলিপাড়া এলাকায় ভাড়াটিয়া হিসেবে টিওবয়েল মিস্ত্রির আড়ালে ধীরে ধীরে মাদকের সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। তবে আজিজ কৌশলে স্থানীয় কালু ফকিরের মেয়ে বিয়ে করে বনে যান। মজিদ বিয়ে করেন রবের মেয়েকে।
এরা এলাকায় গড়ে তুলেন মাদক, কিশোর গ্যাং জমিদখল সিন্ডিকেট বাহিনী । আজিজ তার বাহিনীরা টাকার বিনিময়ে কখনো সরকারি দলের আবার কখনো বিরোধী দলের মিটিং মিছিল করে বেড়ান। এদের মুল কাজ রাজনৈতিক দলে ছত্রছায়ায় এলাকায় মাদক ব্যবসা ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা।
জানাযায়, গত ২ মাস ধরেই হামলার পরিকল্পনা করা হচ্ছিলো। হামলার মূল হোতা আজিজ তার কিশোর গ্যাং বাহিনী নিয়ে এলাকায় নাশকতা করতে পারে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে প্রয়োজনীয় যাবতীয় ব্যবস্থা নিতে একাধিকবার রাজশাহী মহানগরীর পুলিশ কমিশনার জনাব আনিসুর রহমান ও বোয়ালিয়া থানার ওসি সোহরাওয়ার্দী হোসেন কে অভিযোগ করা হয়। কিন্তু, তারা অভিযুক্ত আজিজ বাহিনীর বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। বরং তাদের কে আগে থেকেই অভিযোগের বিষয়ে জানিয়ে দিয়ে সতর্ক করা হত বলে অভিযোগ উঠেছে। আজিজ ও তার বাহিনী বেশ কযেক বছর থেকেই বেপরোয়া । তারা এলাকায় ত্রাস রাজত্ব সৃষ্টি করে আসছিল। অনেকদিন থেকেই আহত ব্যক্তিদের প্রাণ নাশের হুমকি দিয়ে আসছিল।
এঘটনার জেরধরে গত (২৭ জুন) সন্ধ্যার পর নগরী সিএনবি’র মোড় এলাকায় আহত মুকুল ও মনার চাচাতো ভাই কাজলকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করার চেষ্টা করে আজিজ, হিটলার, সুইট ও সজীব।
এ ব্যাপারে, কাজল বলেন, আমি অটো রিক্সার নিয়ে যাচ্ছিলাম হঠাৎ করে ওরা আমার অটো রিক্সার সামনে ঘিরে ফেলে। সবার হাতে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ছিল। আমি চিৎকার করলে স্থানীয় লোকজন জড়ো হলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। কাজল আরো বলেন, যে, এলাকায় আমাকে ঘিরে ধরেছিল সেখানে হিটলারের শ্বশুরবাড়ি।
এঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি বোয়ালিয়া মডেল থানার পুলিশ।
প্রকাশ্যে দিবালোকে হাতের কব্জি কেটে নেয়ার ঘটনার আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এমনই অভিযোগ করেছেন মামলার বাদি।
অপরদিকে, মামলার আরেক ভিকটিম মনা ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, আসামীদের গ্রেপ্তার তো দূরের কথা উল্টো গত ২৮ শে জুন আমাদের বাড়িতে এসে রাতে শাসিয়ে গেছে বোসপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির এটিএসআই লুৎফর রহমান।
এ ব্যাপারে (এটিএসআই) লুৎফর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ওসি স্যারের নির্দেশে আমি গিয়েছিলাম।
এছাড়াও, মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়েও তদন্তকারী কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। জানাগেছে, ২০২০ সালে গোলাম মোস্তফা বোয়ালিয়া মডেল থানায় কর্মরত থাকা অবস্থায় নানান বিতর্ক সৃষ্টি করেন। পুলিশের ভাবমূর্তি বজায় রাখতে সাবেক পুলিশ কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক তাকে বোয়ালিয়া মডেল থানা থেকে তাকে অন্য থানায় বদলি করেন। পরবর্তীতে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ বোয়ালিয়া মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিসেবে যোগদান করেন সোহরাওয়ার্দী হোসেন। ওসি হিসেবে যোগদানের পরপরই আবারও এসআই মোস্তফাকে বোয়ালিয়া মডেল থানায় তকদির করে তাবে নিয়ে আসেন। এদিকে আসামিদের ধরতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে পুলিশ! ঘটনার ১২ দিন অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
এরআগে, ভয়ংকর সব অপরাধের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে ১০ অক্টোবর ২০২০ সালে কিশোর গ্যাংয়ের ৫৬ জন সদস্যকে আটক করেছিল পুলিশ। রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের ১২টি থানায় একযোগে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ৫৬ জন কিশোর গ্যাং সদস্যকে আটক করে। এরমধ্যে ৩২ জনকে মুচলেকা নিয়ে তাদের অভিভাবকের কাছে তুলে দেয়া হয় ও বাকি ২৪ জনের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এ অভিযান আরো জোরতাল করা হবে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের সাবেক মুখপাত্র অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার গোলাম রুহুল কুদ্দুস স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কিশোর গ্যাং সারা দেশে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। তারা পাড়া মহল্লার প্রভাবশালী, মাস্তান ও বড় ভাইদের হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা একসাথে মাদক সেবন, পাড়া মহল্লায় নারীদের
উত্ত্যক্ত করাসহ ছোট-ছোট ঘটনাকে কেন্দ্র করে মারামারি ও ঝগড়া বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় খুন ধর্ষণের মত ঘটনাও ঘটছে এলাকায় । কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধ করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করছে এবং পরিকল্পনা করছে। এ পরিস্থিতিতে সাবেক পুলিশ কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিকের নির্দেশে গত ১০ অক্টোবর ২০২০ সালে কিশোর গ্যাং ও কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে আরএমপি সর্বাত্মক অভিযান শুরু করেছে আরএমপি।
এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ১২ থানাধীন বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালানো হয়। অভিযানে ৫৬ জন কিশোর গ্যাং এর সদস্যদের আটক করা হয়। আটককৃতদের থানায় এনে যাচাই বাছাই করা হয়। যাচাই বাছাই শেষে ৩২ জনকে মুচলেকা নিয়ে তাদের অভিভাবকের নিকট জিম্মায় প্রদান করা হয়। বাকিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এর পর থেকে
এ ধরনের অভিযান চলতে থাকবে বলে জানানো হয়। এবং কিশোর গ্যাং এর সদস্যরা অন্য কোন অপরাধের সাথে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে ওই ঘটনার পর থেকে এ পর্যন্ত কিশোর গ্যাং গ্রুপের আর কোনো হালনাগাদ বা তালিকা তৈরি করা হয়নি। কিশোর গ্যাং এর কোন সদস্য বা গডফাদার কিংবা কোন বড় ভাইদের ও আইনের আওতায় আনা হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের কেউ কথা বলতে রাজি হয়নি।